আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষে আনুমানিক ৪২ মিলিয়ন মানুষ থাইরয়েডের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন, এবং মোট ভারতীয় জনসংখ্যার আনুমানিক ১১% মানুষ হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত।
সাধারণত বয়সের সাথে সাথে প্রকোপ বাড়ে থাইরয়েড জনিত সমস্যার। তবে কম বয়সি এমনকি বাচ্চাদের মধ্যেও এর উপসর্গ লক্ষ্য করা যায়৷ পুরুষদের তুলনায় মহিলারা আটগুণ বেশি আক্রান্ত হন। শরীরের শক্তি, বৃদ্ধি এবং বিপাকীয় হার বজায় রাখার জন্য অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাইরয়েড হরমোন৷ থাইরয়েড হরমোন গুলির মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি বা হ্রাস পেলে সমস্যার সৃষ্টি হয়৷ শরীরে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে গেলে হাইপোথাইরয়ডিজমের সৃষ্টি হয়, যা বৃদ্ধি এবং বিপাকীয় হার তরান্বিত করে।
হাইপোথাইরয়ডিজম আসলে কি?
‘হাইপো’ শব্দের অর্থ কম। যখন কোন কারণে থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনের তুলনায় কম থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে তখন সেও অবস্থাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে। অর্থাৎ শরীরের এন্ডোক্রাইন সিস্টেম বা অন্তঃ-স্রাব তন্ত্রের অসুস্থতাই হল হাইপোথাইরয়েডিজম। থাইরয়েড গ্রন্থি, প্রয়োজনীয় পরিমাণ থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে না পারার কারণে শরীরের ঠাণ্ডা সহ্য করবার ক্ষমতা কমে যাবার পাশাপাশি ক্লান্তি-অবসাদ, কোষ্ঠকাঠিন্য, বিষণ্ণতা, ওজন বেড়ে যাওয়ার সমস্যা হয়, যাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে। গর্ভাবস্থায় হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসা না হলে, বাচ্চার সার্বিক বৃদ্ধি এবং বুদ্ধির বিকাশ দেরীতে হয়, যাকে ক্রেটিনিজম বলে। কোষ, খাবার থেকে পাওয়া এনার্জিকে কীভাবে ব্যবহার করবে সেটাকে থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই প্রক্রিয়াকে বিপাকক্রিয়া বা মেটাবোলিজম বলে। বিপাকক্রিয়া অন্যান্য কিছু বিষয়ের সাথে শরীরের তাপমাত্রা, হৃৎস্পন্দন এবং ক্যালোরি ঝরে যাওয়াকে প্রভাবিত করে। থাইরয়েড হরমোনের অভাবে শরীরের সব প্রক্রিয়া ব্যাহত হবার কারণে কম এনার্জি তৈরি হয় এবং বিপাকের হার কমে যায়। সাধারণত ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের মধ্যে এর প্রভাব বেশি দেখতে পাওয়া যায়৷ কিন্তু তা শুরু হতে পারে যেকোনো বয়সে।
থাইরয়েডজিমের প্রভাব সামান্য থাকলে ডাক্তারি পরিভাষায় তাকে সাবক্লিনিকাল হাইপোথাইরয়ডিজম বলা হয়।
ডাক্তাররা এই রোগের চিকিৎসায় সাধারণত যে ওষুধ গুলি প্রয়োগ করেন তাতে শরীরে কৃত্রিম হরমোন প্রবেশ করানো হয়। যাতে শরীর তার শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ সঠিক মাত্রায় বজায় রাখতে পারে।
কিভাবে বোঝা যায় কেউ হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা?
১. ক্লান্তি এবং অবসন্নতা
নিয়মিত শরীর অবসন্ন বা ক্লান্ত লাগার একটি অন্যতম কারণ হতে পারে হাইপোথাইরয়ডিজম। হাইপোথাইরয়ডিজম হল শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় কম থাইরয়েড হরমোন তৈরি হওয়া। সারা রাত পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরেও যদি সকালে অবসন্ন লাগে অথবা সারা দিন ধরে ঝিমুনি আসে তাহলে থাইরয়েড হরমোন ঠিক মতো কাজ করতে কিনা পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। হাইপোথাইরয়ডিজম আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব লক্ষ্য করা যায়৷ ৫০% রোগীদের মধ্যে সারাক্ষণ ক্লান্তি ভাব লক্ষ্য করা যায়৷
২. ওজন বৃদ্ধি
অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি, হাইপোথাইরয়ডিজমের একটি সাধারণ লক্ষণ।
খাওয়ার পরিমাণ না বাড়ানো সত্ত্বেও হঠাৎ করে ওজন পরিবর্তিত হলে থাইরয়েড হরমোনের পরীক্ষা করানো উচিত। একই ভাবে যাঁদের হঠাৎ করেই বেশ খানিকটা ওজন কমে যায়, তাঁদেরও হাইপারথাইরয়েডিসম থাকার আশঙ্কা রয়েছে। একই ভাবে যাঁদের হঠাৎ করেই বেশ খানিকটা ওজন কমে যায়, তাঁদেরও হাইপারথাইরয়েডিসম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
সমীক্ষা বলে এক বছরে ৭-১৪ কেজি অব্ধি ওজন বৃদ্ধি হতে পারে হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত হলে৷
এরকম সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন, তিনি প্রয়োজনীয় ওষুধের সাথে সাথে সঠিক ডায়েট এবং ব্যায়ামের তালিকা দেবেন৷
অন্যান্য কোষের মতো হেয়ার ফলিকল গুলিও থাইরয়েড হরমোনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই হাইপোথাইরয়ডিজম হলে অতিরিক্ত চুল পড়া, চুলের বৃদ্ধি কমে যাওয়ার মতো একাধিক সমস্যা দেখা দেয়। থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতা বা আধিক্য, দুটিই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তবে সময় মতো শনাক্ত করতে পারলে
গবেষণায় দেখা গেছে ২৫-৩০% হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত রোগী এই সমস্যার শিকার। বয়স চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়ার পর এই পরিসংখ্যান গিয়ে দাঁড়ায় চল্লিশ শতাংশে। নির্দিষ্ট মাত্রার ওষুধ খেয়ে পুরোপুরি সুস্থ থাকা সম্ভব। তাই থাইরয়েড হরমোন সমস্যার কোনও লক্ষণ দেখা গেলে তা অবহেলা করে ফেলে না রেখে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৪. সারাক্ষণ ঠান্ডা অনুভব করা
ক্যালোরির দহন হলে তাপ উৎপন্ন হয়৷ যেমন শরীরচর্চার সময় আমাদের গরম অনুভব হয়, কারণ শারীরিক পরিশ্রমের ফলে শরীরে জমে থাকা ক্যালোরির দহন হয়।
হাইপোথাইরয়ডিজমের ফলে শরীরের বিপাকীয় হার বা বিএমআর হ্রাস পায়, তার ফলে শরীরের উৎপাদিত তাপের পরিমাণও হ্রাস পায়। ব্রাউন ফ্যাট শীতল পরিবেশে শরীরকে তার সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। হাইপোথাইরয়ডিজম তাকে এই কাজে বাধা দেয়। তাই শরীরে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি সবসময় ঠান্ডার অনুভূতি দেয়।
৫. মাংসপেশি এবং জয়েন্টে ব্যাথা
শরীরে থাইরয়েড হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা কমে গেলে, অপচিতি বিপাকক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, যা মাংসপেশির শক্তি ক্ষয় করে।
এই অপচিতি বিপাকক্রিয়া মাংসপেশিকে দুর্বল করে, যার ফলে সামগ্রিক শারীরিক দুর্বলতার সৃষ্টি হয় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথার অনুভূতি হয়। হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত রোগীরা একজন সুস্থ মানুষের তুলনায় দ্বিগুণ দুর্বলতা অনুভব করেন।
৩৪% আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে মাসল ক্র্যাম্পের মতো সমস্যা দেখা যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, থাইরয়েড হরমোনের কম থাকার জন্য সিন্থেটিক থাইরয়েড হরমোন, যেমন লিভোথাইরক্সিন প্রয়োগ করলে মাংসপেশিতে ব্যথা যন্ত্রণার অনুভূতি কম হয়।
৬. রুক্ষ এবং শুষ্ক ত্বক
হেয়ার ফলিকলের মতো ত্বকের কোষগুলিও থাইরয়েড হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে ত্বকের কোষ গুলি ভেঙে গেলেও একটি নির্দিষ্ট সময়ে তা আবার বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ত্বকের বাইরের অংশে মৃত কোষ জমা হয়।
তাই হাইপোথাইরয়ডিজমের কারণে ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে যায়।এছাড়াও হাইপোথাইরয়ডিজমের কারণে শরীরের আভ্যন্তরীণ তাপ কমে যাওয়ার ফলে ঘাম কম হয় এবং ত্বক তার প্রয়োজনীয় আদ্রর্তা পায় না। ফলে ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে যায়। হাইপোথাইরয়েডিসমের রোগীদের মধ্যে নখ ভাঙ্গার বা নখে ফাটল ধরার প্রবণতাও বেশি। ৭৪% হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত রোগী শুষ্ক ত্বকের সমস্যায় ভোগেন এবং ৫০% রোগী একটি সমীক্ষায় দাবি করেছেন হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের ত্বক দিন দিন খারাপ হয়েছে।
তবে মনে রাখা প্রয়োজন, হাইপোথাইরয়ডিজমের কারণে মিক্সিডিমার জন্য শুষ্ক ত্বকের সমস্যা দেখা দেয়।
৭. মানসিক অবসাদ
হাইপোথাইরয়ডিজম এর সাথে অবসাদের একটা সংযোগ রয়েছে সবসময়। এর সঠিক কারণ জানা না গেলেও, সম্ভবত সবসময় শারীরিক দুর্বলতার অনুভূতি এর কারণ হতে পারে।
৬৪% মহিলা এবং ৫৭% পুরুষ হাইপোথাইরয়ডিজমের কারণে মানসিক অবসাদে ভোগেন৷ এবং এর সাথে দেখা দেয় অ্যাংজাইটির মতো সমস্যা।
বেশ কয়েকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কমবয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই মানসিক অবসাদের কারণ আলাদা। হাইপোথাইরয়ডিজমের কারণে বিঘ্নিত হয় তাদের স্বাভাবিক যৌন জীবন৷ এর ফলে গ্রাস করে মানসিক অবসাদ।
অনেক রোগীর ক্ষেত্রে আবার সন্তান প্রসবের পর দেখা যায় এই মানসিক অবসাদের মতো সমস্যা।
এরকম সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই কাউন্সেলরের সাথে কথা বলুন। মানসিক অবসাদকে কখনোই অবহেলা করবেন না৷
৮. স্মৃতিভ্রম
হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রায়শই দেখা যায় যে তারা কিছু মনে রাখতে পারছেন না৷ প্রথমদিকে বিষয় টা খুব সাধারণ স্তরে থাকলেও ক্রমে তা বড় আকার ধারণ করে, এবং স্মৃতিভ্রংশ বা স্মৃতিভ্রমের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়।
২২% হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত রোগী রোজকার সাধারণ অঙ্ক কষতে পারেননা, ৩৬% রোজকার ঘটনা মনে রাখতে পারেন না। এবং ৩৯% স্মৃতিভ্রম বা স্মৃতিভ্রংশের মতো সমস্যায় ভোগেন।
৯. কোষ্ঠকাঠিন্য
শরীরে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি কোলনের কার্যকারিতাকে রুদ্ধ করে৷
১৭% মানুষের কোষ্ঠকাঠিন্য হয় থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতির কারণে৷
মার্কিন গবেষণা অনুযায়ী ২০% হাইপোথাইরয়ডিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা গুরুতর। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দিলে প্রাথমিক অবস্থায় প্রাকৃতিক ল্যাক্সাটিভ ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু তাতে কাজ না হলে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই প্রয়োজন।
১০. অনিয়মিত এবং অতিরিক্ত মাত্রায় রজঃস্রাব
অনিয়মিত মাসিক এবং অতিরিক্ত মাত্রায় রক্তপাত হাইপোথাইরয়ডিজমের একটি প্রধান উপসর্গ।
৪০% মহিলারা থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতির কারণে এইরূপ অনিয়মিত মাসিক বা অতিরিক্ত মাত্রায় রক্তপাতের মতো সমস্যায় ভোগেন৷
আরেকটি গবেষণায় দেখা যাক গেছে যে ৩০% মহিলারা হাইপোথাইরয়ডিজমের কারণে মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাতের সমস্যায় ভোগেন।
থাইরয়েড হরমোন, অন্যান্য হরমোনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে মেন্সট্রুয়েশন সাইকেলকে নিয়ন্ত্রণ করে।
থাইরয়েড হরমোন সরাসরি জরায়ু এবং ডিম্বাশয়ে প্রভাব ফেলে।
এইরকম সমস্যার সৃষ্টি হলে অবিলম্বে গাইনোকলজিস্টের পরামর্শ নিন৷