বাতের ব্যথা এখন ঘরে ঘরে। ভারতবর্ষে ১৫ কোটিরও বেশী মানুষ বাতের ব্যথা বা আর্থারাইটিসে ভোগেন। এমনকি এই আর্থারাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা AIDS, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদিতে আক্রান্তের থেকেও বেশি।পশ্চিমা দেশগুলির তুলনায় ভারতীয়রা অনেক বেশি ভুগছেন। প্রত্যেক বছর ভারতীয় মোট জনসংখ্যার ১৪% মানুষ গাঁটের যন্ত্রণার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন।
বাত একটি সিস্টেমিক ডিজিজ অর্থাৎ যা কিনা পুরো শরীরে প্রভাব ফেলে। সাধারণত আমাদের দুটো হাড়ের সংযোস্থলে ক্ষয়ের প্রভাবে হয়ে থাকে। এর ফলে যে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হয়, তা সহ্য করা খুব কষ্টকরই হয়ে পড়ে রোগীর পক্ষে। ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে গড়ে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে এই সমস্যা খুব সাধারণ, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে গড় বয়স ৬০। শুধু বেশি বয়সের মানুষই নন, কমবয়সীরাও বাতের সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরবর্তীকালে আর্থ্রাইটিস বিশেষত হাঁটুর বাত ভারতে শারীরিক অক্ষমতার চতুর্থ সাধারণ কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামো এবং অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞের ঘাটতির কারণে আমাদের দেশের পক্ষে এই বিশাল স্বাস্থ্যসেবার বোঝা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বাতের ব্যথা বা আর্থাইটিসের উপসর্গ গুলি কি কি ?
আর্থাইটিসের প্রধান উপসর্গই হল গাঁট ফুলে শক্ত ও লাল হয়ে ওঠা, আড়ষ্টতা যেটা বয়সের সাথে সাথে আরও খারাপ আকার ধারণ করে। এর সাধারণ কতগুলি লক্ষণ হল-
- হাত পায়ে অক্ষমতা, হাঁটতে সমস্যা
- শরীরে অস্বস্তি বোধ
- ওজন কমে যাওয়া
- পেশীর ব্যথা ও দুর্বলতা
- পরিমাণ মতো ঘুম না হওয়া
- শরীরের যে কোনো অংশ ফুলে ওঠা বা ফোলাভাব
- বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা
- হাড়ের বিভিন্ন জয়েন্ট বিকৃত হয়ে যাওয়া
আর্থারাইটিসের জন্য কোন কোন বিষয় গুলি দায়ী হতে পারে ?
আর্থ্রাইটিসের তেমন নির্দিষ্ট কোন কারণ থাকে না। এর কারণ গুলি আর্থ্রাইটিসের টাইপ বা ধরণ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। এর সম্ভাব্য কারণ গুলি নিম্নলিখিত হতে পারে-
১। গাঁটে কোন আঘাত বা বড়সড় চোট যেটা ভবিষ্যতে বাতের দিকে এগোতে পারে।
২।রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যাওয়া
৩। অনিয়মিত জীবনযাপন ও দৈনন্দিন জীবনে অতিরিক্ত কাজের চাপ
৪। শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব
৫। গাঁটের কোনোরকম ইনফেকশান
৬। জিনগত সমস্যার কারণে হতে পারে বিশেষত অষ্টিওপোরোসিস। পূর্বের কোন আঘাত, সংক্রমণ, ধূমপান এছাড়া যে সমস্ত পেশায় শারীরিক পরিশ্রম বেশী ইত্যাদির মতো অতিরিক্ত কারণগুলি জিনের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। শতকরা ২০ ভাগেরও বেশি রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাতরোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে।
৭। খাদ্যাভ্যাস এবং সঠিক পুষ্টির অভাব বাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। গাত্র প্রদাহ বৃদ্ধি করে এমন সব খাবার, বিশেষত প্রাণীজাত খাবার এবং পরিশোধিত চিনি বা refined sugar এর মতো উচ্চমাত্রার ডায়েট লক্ষণগুলিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে।
৮। কিছু ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ যেমন ক্লিবসেলা (Klebsiella) ও এলার্জির কারণে কিছুদিনের জন্য বাতের ব্যাথা হতে পারে। সংক্রমণের কারণে সংঘটিত বাতরোগকে রিএকটিভ আর্থ্রাইটিস/Reactive arthritis বলে।
কি কি ধরণের আর্থারাইটিস হতে পারে ?
আর্থ্রাইটিস আসলে কোন একটা একক রোগ নয়। আর্থাইটিস অনেক রকমেরই হতে পারে পারে, তবে প্রধানত দুই রকমের আর্থাইটিস – অষ্টিওআর্থারাইটিস (Osteoarthritis) এবং রিওম্যাটওয়েড আর্থারাইটিস (Rheumatoid Arthritis )
অষ্টিওআর্থারাইটিস / Osteoarthritis– অষ্টিওআর্থ্রাইটিসের অন্যতম প্রধান কারণ বয়স। বয়স যত বেশি, জয়েন্টের ক্ষয়ও ততো বেশী। এছাড়াও পুরনো কোনও চোট যেমন ছেঁড়া কারটিলেজ, স্থানচ্যুত জয়েন্ট, লিগামেণ্টের আঘাত ইত্যাদিও এর জন্য দায়ী হতে পারে। হাত, ঘাড়, পিঠ, পিঠে, হাঁটু বা নিতম্বের জয়েন্টে ব্যথা হওয়া এর সর্বাধিক সাধারণ লক্ষণ।
রিওম্যাটওয়েড আর্থারাইটিস/ Rheumatoid Arthritis/ গাঁট – ফোলানো বাত – রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে শরীরের Immune System বা রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা নিজের শরীরের উপরই আক্রমণ করে । এটি প্রধানত শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে বা গাঁটে, হাড়ের আস্তরণের কে ক্ষতিগ্রস্ত করে শেষ পর্যন্ত গাঁট বা joint এর কারটিলেজ এবং হাড়কে নষ্ট করে । এই রোগ সারে না সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিলে শরীরের অন্যান্য অংশও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আর্থ্রাইটিসের আরও কয়েকটি প্রকার হল –
সোরিয়াটিক আর্থারাইটিস / Psoriatic Arthritis – হাত পায়ের আঙ্গুলের গাঁট ফুলে শক্ত হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি রোগীর চামড়া লালচে আঁশের মতন দেখতে হয় এবং চুলকানি হতে দেখা যায়। এই ধরনের সোরিয়াসিস কনুই এবং হাঁটুর উপরিভাগ, মাথার ত্বক, নাভি এবং যৌনাঙ্গে বা মলদ্বারের চারপাশ লক্ষ্য করা যায় । এতে এক বা একের বেশী গাঁট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। প্রায় 10% থেকে 30% সোরিয়াসিস আক্রান্তরা সোরোরিটিক বাতে ভোগেন। এটি ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সি পুরুষ বা মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই দেখা যেতে পারে।
গেঁটে বাত / Gout – রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অস্থিসন্ধিতে মনোসোডিয়াম ইউরেট মনোহাইড্রেট ক্রিস্টাল জমা হয়ে গাউট রোগ সৃষ্টি করে। মূত্রের মাধ্যমে যে পরিমাণ স্বাভাবিক ইউরিক এসিড বেরিয়ে যায়, তার থেকে বেশি পরিমাণ ইউরিক অ্যাসিড যখন আমাদের যকৃত তৈরি করে তখন সেই অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড আমাদের শরীরে জমা হয় অথবা ইউরিক এসিড সৃষ্টি করে এমন খাবার যেমন লাল মাংস, ক্রিম, রেড ওয়াইন ইত্যাদি গ্রহণ করলে আমাদের বৃক্ক (কিডনি) রক্ত থেকে যথেষ্ট পরিমাণে তা ফিল্টার করতে না পারলে গেঁটে বাতের উদ্ভব হতে পারে। হঠাৎ করে পায়ের পাতায় তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার উদ্ভব হয়।.৫০% ক্ষেত্রে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিকে এছাড়াও পায়ের গোড়ালি, মধ্য পা, হাঁটু, কব্জিসন্ধি, কনুই, হাতের ছোট জয়েন্টগুলোকে আক্রান্ত করে। বেশী মাত্রায় ওষুধপত্র সেবন, অ্যালকোহল, অত্যধিক মানসিক চাপ, অন্যান্য রোগ ইত্যাদি এর কারণেও গেঁটে বাত হতে পারে।
লুপাস / Lupus– রিওম্যাটওয়েড আর্থারাইটিসের মতন লুপাসও একটি অটোইমিউন রোগ যা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দ্বারা শরীরের বিভিন্ন সুস্থ কোষ এবং টিস্যু গুলিকে আক্রান্ত করে। এর দ্বারা হাড়ের সন্ধিস্থল বা জয়েন্ট সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করতে থাকে। অটোইমিউনিটি কেই এখনও অবধি এর কারণ হিসাবে ধরা হয়। চূল পড়া, মুখে ঘা, রোদ সহ্য না হওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা, গাঁটে ফোলাভাব ইত্যাদি লুপাস এর লক্ষণ। যদিও লুপাস এর কোন স্থায়ী নিরাময় হয়না, তাও চিকিৎসা করে এর প্রাবল্য কমিয়ে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলিকে ক্ষতিসাধনের হাত থেকে বাঁচানো যায়।
আর্থারাইটিসের চিকিৎসা কি ?
বাতের বা আর্থারাইটিস এর ধরণের ওপর নির্ভর করে এর চিকিৎসা করা হয়। বাত নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক রোগীর লক্ষণগুলি বিবেচনা করেন, ফোলা জয়েন্টগুলির বা চলন ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য একটি শারীরিক পরীক্ষা করবেন এবং বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য রক্ত পরীক্ষা এবং এক্স-রে ব্যবহার করবেন। এক্স-রে এবং রক্ত পরীক্ষাগুলি রোগীর আর্থ্রাইটিসের ধরণ নির্ণয় করতে সহায়তা করে।
চিকিৎসা না করা হলে বাত অস্থিসন্ধির যথেষ্ট ক্ষতি করতে এমনকি চলার ক্ষমতাও কমিয়ে দিতে পারে। সচরাচর ঘন ঘন রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ না পেলে অনেকে এর চিকিৎসা করাতে চান না। জয়েন্ট একেবারে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে আর্থারাইটিসের চিকিৎসা মূলত ওষুধের মাধ্যমেই করা হয় ওষুধের মধ্যে আছে ন্যাপ্রোক্সেন এবং ইন্ডোমিথাসিনের মতো এনএসএআইডি/ NSAID জাতীয় ওষুধ। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়ানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা এবং সেই সঙ্গে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
কীভাবে বাতের ব্যথা কে প্রতিরোধ করা যায় ?
প্রতিরোধই বাতের সমস্যা থেকে উপশমের উত্তম উপায়। রোগ দেখা দিলে ওষুধের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া যায় বটে, তবে নিম্নলিখিত উপায়ে এর প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে-
অ্যালকোহল এবং যেসব খাবার গ্রহণ করলে ইউরিক অ্যাসিড মজুদ হওয়া বেড়ে যায়, সেসব থেকে দূরে থাকা অবশ্যই উচিৎ।
এমন সমস্ত খাবার খেতে হবে, যা হাড়কে মজবুত রাখে। বাতের সমস্যা তৈরি করে এমন সব খাবার যেমন, মিষ্টি, ডিম, সোয়াবিন এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য খাওয়া কমাতে হবে। অতিরিক্ত নুন খাওয়া ত্যাগ করতে হবে।প্রচুর পরিমাণে তাজা শাক-সব্জি, ফল খাওয়া খুব জরুরি।
বাতের ব্যথায় কষ্ট হলেও মন কে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। কারণ মানসিক চাপ বাতের ব্যাথা আরও বাড়িয়ে তলে। তাই মস্তিষ্ক শান্ত রাখতে যোগাসন অভ্যাস করতে পারেন।
ব্যথা উপশমের আরও একটি দারুণ উপায় হল নিয়মিত ব্যায়াম। বাতের সমস্যা অতিরিক্ত হলে একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তিনিই বিভিন্ন ব্যায়ামের মাধ্যমে আপনার কষ্টের উপশম ঘটাতে পারবেন।
এছাড়া প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে।
শরীরের ওজন ঠিক রাখতে হবে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই রোগ হলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে তার পরামর্শ মতো চলতে হবে।