ঘুম একটি অত্যাবশ্যক শারীরবৃত্তিক ক্রিয়া I উপযুক্ত পরিমাণ এবং গুণমানের ঘুম আমাদের সুস্বাস্থ্যের অন্যতম উপাদান I ঘুমের সময় নাক ডাকা কখনোই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয় I প্রকৃতপক্ষে ঘুমের সময় নাক ডাকা এক ধরনের রোগের লক্ষণ যার নাম অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বা সংক্ষেপে OSA. কোন ব্যক্তির জীবনে এই OSA রোগের সূত্রপাত এক ধরনের বিপদ ঘন্টা I OSA রোগ থেকে জন্ম হয় বিভিন্ন ধরনের রোগের এই নিয়ে আজকে আমাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা I
প্রথমেই দেখা যাক নাক ডাকার কারণ কি ?
এই রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ঘুমের সময় I আমাদের উচ্চ শ্বাসনালী বা আপার রেসপিরেটরি ট্রাক্ট একটি নলের মতো পরিসর যার মাধ্যমে বাতাস আমাদের শ্বাসযন্ত্র প্রবেশ করে ও সেখান থেকে অনেকটা পথ অতিক্রম করে ফুসফুসে প্রবেশ করে I উচ্চ শ্বাসনালী শুরু হয় নাকে (Nose) . সেখান থেকে Nasopharynx , Oropharynx, Larynx, Trachea, Bronchi প্রবেশ করে I
প্রকৃতপক্ষে লারিংস এর পর থেকেই শুরু হয় নিম্ন শ্বাসনালি বা লোয়ার রেস্পিরাটরি ট্রেক্ট I নিম্ন শ্বাসনালি বা লোয়ার রেস্পিরাটরি ট্রেক্ট এর উপরের অংশ অর্থাৎ উচ্চ শ্বাসনালী সর্বদা বন্ধ হয়ে যাওয়ার এক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় সমস্ত মানুষের মধ্যে I কিন্তু জেগে থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের মাংসপেশির কার্যকারিতার কারণে তা সম্ভব হয় না I কিন্তু আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি আমাদের মাংসপেশি ঘুমিয়ে পড়ে I এইসময় এই মাংসপেশিগুলি শিথিল হয়ে শ্বাসনালীর গতিপথ অবরুদ্ধ করে I যদি আমাদের উচ্চ শ্বাসনালীতে অতিরিক্ত চর্বি জমে তাহলে, এই গতিপথ অবরুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় I এছাড়াও উচ্চ শ্বাসনালীর গঠনগত ত্রুটির কারণও শ্বাসনালীর গতিপথ অবরুদ্ধ হয় আর ঘুমের সময় নাক ডাকা হল এই অবরুদ্ধ শ্বাসনালির আর্তনাদ I
ঘুমের সময় এই অবরুদ্ধ গতিপথ দুইভাবে আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এবং শারীরিক ক্ষতির কারণ হয় I বাতাস ফুসফুসে না ঢুকতে পারার কারণে যেমন রক্তে ও শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় তেমনি শরীরে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রাও বাড়তে থাকে I রক্তের এই ভারসাম্যহীনতা বা রাসায়নিক পরিবর্তন আমাদের শরীরে এক ধরনের stress বা পিড়ন এর কারণ হয়, কেননা এই সময়ে আমাদের সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ে I দ্বিতীয়তঃ এই রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণে আমাদের মস্তিষ্ক জেগে যায়I জেগে যাওয়া আমরা সবসময় বুঝতে পারি তা নয়, কিন্তু বৈদ্যুতিক ভাবে মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে পড়ে I উচ্চ শ্বাসনালী আবার খুলে যায় এবং বাতাস চলাচল স্বাভাবিক হয় I এই ঘটনা যদি বারংবার ঘটতে থাকে তাহলে আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে I আমরা গভীর ঘুমে যেতে পারিনা I পরবর্তী সকালে ওঠার পর আমাদের মনে হয় ঘুম ঘুম ভাব থেকে গেছে সারাদিন ক্লান্তি অনুভব করি I শরীরে অক্সিজেন কম থাকার কারণে আমাদের শরীরের মেরামতি, যা বাস্তবিক ভাবে হয় ঘুমের সময়, সেটি ব্যাহত হয় I আমাদের বয়স অস্বাভাবিক তাড়াতাড়ি ভাবে বৃদ্ধি পায় I ফলে দেখা যায় যে রোগ আসার কথা বৃদ্ধবয়সে চলে আসে যৌবনে I
এবার দেখা যাক কি কি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে এই OSA থেকে ?
বহু রোগের জনক এই OSA . উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর, অ্যাট্রিয়াল ফিব্রিলেশন এই রোগগুলি জন্ম নেয় বা বল শালী হয় OSA রোগ এ I এই রোগে জন্ম নেয় ডায়াবেটিস, ওবেসিটি ইত্যাদি I বিভিন্ন স্নায়ুজনিত সমস্যা যেমন স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া এইসব রোগ বৃদ্ধি পায় OSA ও অপরিমিত ঘুমের কারণে কমে যায় শারীরিক প্রতিরোধক্ষমতা I সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে যেসব রোগ ক্রমবর্ধমান তার অন্যতম হলো এই OSA. পৃথিবীতে 7 থেকে 10 শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত, ভারতীয়দের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা অত্যন্ত বেশি I
কিভাবে আমরা বুঝব আমরা এই রোগে আক্রান্ত ?
এই রোগের লক্ষণগুলি হলো নাকডাকা, অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব, সর্বদা শারীরিক ক্লান্তিI যদি এই ধরনের কোন লক্ষ্মন আপনার থাকে, আপনি ডাক্তার বাবুর সাথে যোগাযোগ করুন I এখন এই রোগের যথার্থ নির্ণয় ও চিকিত্সা সম্ভব আমাদের এই শহরে I OSA রোগ নির্ণয় করা হয় একটি পরীক্ষার মাধ্যমে যার পোশাকি নাম পলিসম্নগ্রফি I এই পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটির উপস্থিতি প্রমাণিত হলে এর চিকিৎসা শুরু হয় I এখনো পর্যন্ত এই রোগের চিকিৎসা হল একটি যন্ত্র যার নাম CPAP . ঘুমের সময় এই যন্ত্রটি নাকে পড়ে ঘুমোতে হয় I বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এখন প্রমাণিত যে এই যন্ত্র ব্যবহারে ব্যাহত করা যায় বহু রোগের প্রাদুর্ভাব I
সুতরাং না কখনোই অবহেলা করবেন না I নাক ডাকা হলো এক ধরনের বিপদ ঘন্টি I সুস্থ থাকার অন্যতম শর্ত হল নিশ্চিত এবং নিঃশব্দে ঘুম I