গরমকালের শুরুতে বা শেষে আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের সময়ে দেখা দেয় নানা অসুখ বিসুখ। এগুলি বেশিরভাগই সংক্রামক ব্যাধি। যেগুলি মানুষ থেকে মানুষে, মশা থেকে মানুষে, জল থেকে মানুষে ছড়ায়। এ সময়ে ছড়ায় এমনি একটি মারাত্মক রোগ হল টাইফয়েড।টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা ও কীভাবে তার প্রতিরোধ করা যায় সেগুলি বলব।
টাইফয়েড রোগ জলবাহিত। সালমোনেলা টাইফি (Salmonella Typhi) ও প্যারাটাইফি জীবাণু থেকে টাইফয়েড রোগ হয়ে থাকে। জ্বরের সময় তাপমাত্রা ১০৩ থেকে ১০৪ ফারেনহাইট অব্ধি হয়, তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই জ্বর প্রথম সপ্তাহে ধরা পড়ে না। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে জ্বর ধরা পড়ে এবং মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ওষুধ চললেও সপ্তাহ খানেক থাকতে পারে এই জ্বর।
টাইফয়েড কী?
টাইফয়েড একটি সংক্রামক জীবাণুঘটিত (ব্যাকটেরিয়া ঘটিত) অসুখ যা সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার কারণে ঘটে। এই অসুখটা প্রাক-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষাশেষেই সাধারণত বেশি মাত্রায় ছড়ায়। মল এবং মৌখিক (ওরাল) পথের মাধ্যমে টাইফয়েডের সংক্রমণ ঘটে। সেজন্য, টাইফয়েডের জীবাণু সংক্রমণ নিশ্চিত করতে মল পরীক্ষা করা হয়। টাইফয়েডের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক্সের ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসা সঠিক ভাবে না হলে আভ্যন্তরীণ রক্তপাত, পচন বা সেপসিস অথবা বিরল ক্ষেত্রগুলিতে রোগীর মৃত্যু অব্ধি হয়৷
টাইফয়েড জ্বর কী?
টাইফয়েড এবং প্যারাটাইফয়েড জ্বর একত্রে আন্ত্রিক জ্বর হিসাবে পরিচিত। এটি একটি অত্যন্ত পরিচিত সংক্রামক অসুখ যা সালমোনেলা এন্টেরিকা (Salmonella Enterica)-র টাইফি, প্যারাটাইফি A, B, এবং C নামক বিভিন্ন প্রজাতির দ্বারা ঘটে। প্রথমদিকে এটা পাচনতন্ত্রকে আক্রান্ত করে, কিন্তু যদি সঠিক চিকিৎসা না করা হয়, এই অবস্থা আরও গুরুতর দিকে চলে যেতে পারে এবং জীবাণুগুলি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। যদি সময়মত চিকিৎসা না করা যায়, এটা গুরুতর জটিলতার দিকে চলে যেতে পারে যা মারাত্মক আকার নেয়৷
টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণগুলি কী কী?
টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণগুলি অনেকাংশেই আর পাঁচটি জ্বরের মতই তবে বেশ কিছু উপসর্গ আছে যেগুলিকে একেবারেই অবহেলা করা উচিত নয়।
- প্রবল জ্বর । তাপমাত্রা ১০২°- ১০৪° ফারেনহাইটের মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
- পেট ব্যথা
- পেট খারাপ
- কাশি
- ক্ষুধামান্দ্য
- কোষ্ঠকাঠিন্য
প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা না করলে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হতে পারে। সেক্ষেত্রে তখন আরও বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন —
- মানসিক অবসাদ
- মস্তিষ্কের বিভ্রান্তি বা বিভ্রম
- নাক দিয়ে রক্ত পড়া
- মনোযোগে ঘাটতি
- বুক এবং তলপেটে লাল ফুসকুড়ি
প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে টাইফয়েড সংক্রমণের উপসর্গগুলি অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়।
টাইফয়েডের চিকিৎসা কিভাবে সম্ভব?
টাইফয়েডের প্রাথমিক উপসর্গগুলি দেখা দেওয়া মাত্র ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সাধারণত যে যে পদ্ধতিতে টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করা হয় তা হলো —
মেডিকেশন
* অ্যান্টিবায়োটিক
টাইফয়েড জ্বরের পরীক্ষায় রিপোর্ট অনুযায়ী, ৭ থেকে ১৪ দিনের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক এর প্রয়োগ করা হয়।
সাধারণত যে অ্যান্টিবায়োটিক্স গুলি ডাক্তাররাব্যবহারেরপরামর্শ দেন, তা হলো —
• Ciprofloxacin বা Ofloxacin
• Chloramphenicol, Amoxicillin
• Co-trimoxazole
অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক্সের ব্যবহার শুরু করার পর ২-৩ দিনেই উপসর্গ গুলি হ্রাস পেতে শুরু করে, কিন্তু কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক্স নেওয়া বন্ধ করা যাবেনা। ডাক্তারের বলে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক্সের কোর্স শেষ করতে হবে ৷
টাইফয়েড ভ্যাক্সিন
একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের টাইফয়েড ভ্যাক্সিনের প্রয়োজন হয় না। তবে ডাক্তার মনে করলে ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাইফয়েডের বাহক, বাহকের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়৷ সাধারণত দুই ধরনের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়।
• Ty21a (ওরাল)
• ViCPS (ইঞ্জেকশন)
হাইড্রেশন
টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে শরীর থেকে প্রচুর জল বেরিয়ে যায়। অনেকসময়ই রোগী ডিহাইড্রেটেড হয়ে অজ্ঞান অব্ধি হয়ে যায়। তাই এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে। বিশুদ্ধ পানীয় জল, ওআরএস, ফলের রস খেতেই হবে৷
গুরুতর ক্ষেত্রে
অনেকসময় চিকিৎসায় দেরি হলে বা অন্য কোনো কারণবশত ওষুধে কাজ না হলে যদি রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়, সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক্সের ব্যবহার তা দ্রুত কাজ করতে এবং উপসর্গগুলির তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে৷
দ্বিতীয়বারের পরীক্ষা
সম্পূর্ণ চিকিৎসার পর, দ্বিতীয়বার একটি মল বা রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়, এটা নিশ্চিত করতে যে আক্রান্ত রোগীর মলে বা রক্তে আর টাইফয়েডের জীবাণুগুলি বর্তমান নেই। কিন্তু যদি পরীক্ষা রিপোর্ট পজিটিভ আসে সেক্ষেত্রে টাইফয়েড জীবাণুর একজন বাহক (কেরিয়ার) হিসাবে গণ্য করা হবে। এরকম ক্ষেত্রে ডাক্তার সাধারণত একটি ২৮ দিনের মৌখিক অ্যান্টিবায়োটিক্সের কোর্স সম্পূর্ণ করে পুনরায় পরীক্ষা করাতে বলেন।
টাইফয়েড জ্বরের প্রতিকারের উপায়
টাইফয়েড জ্বর থেকে প্রতিকার পেতে গেলে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি অবশ্যই মেনে চলুন –
টাইফয়েড হলে কি কি খাবেন এবং কি কি খাবেন না —
- সরাসরি কলের জল পান করা বন্ধ করতে হবে৷ রোগ প্রতিরোধের জন্য বিশুদ্ধ জল পান করুন। প্রয়োজনে জল ফুটিয়ে খান৷
- আইসকিউব, স্টিক আইসক্রিম ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।
- বাইরে বেরোলে প্যাকেজড জল কিনে খান। কলের বা কুয়োর জল কোনোভাবেই ব্যবহার করবেন না।
- পাস্তুরাইজড দুধ, গরম চা, গরম কফি সঠিক মাত্রায় পান করা টাইফয়েড প্রতিরোধে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়।
- কোনো খাবারই কিনেই খাবেন না , ভালো ভাবে ধুয়ে, হাত ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে খান।
- যেকোনো সবজি ভালো ভাবে রান্না করে খান, কাঁচা অবস্থায় কোনোভাবেই খাবেন না৷
- রাস্তার ধারে ঠেলাগাড়িতে খোলা অবস্থায় রাখা খাবার এড়িয়ে চলুন।
- মাছ বা মাংস সঠিক ভাবে রান্না করে গরম অবস্থায় খান ৷
- পাস্তুরাইজড ডেয়ারি প্রোডাক্ট ব্যবহার করুন। ডিম অনেকক্ষণ ধরে সেদ্ধ করে তারপর খান ৷
- দীর্ঘক্ষণ ধরে কেটে রাখা স্যালাড খাবেন না।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন
- জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সব সময় পরিষ্কার পোশাক পরুন।
- বাইরে বেরোলে, খাওয়ার আগে, চোখে মুখে হাত দেওয়ার আগে ভালোভাবে সাবান দিতে হাত ধুয়ে নিন। সাবান ব্যবহার করতে না পারলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন।
- ঘরের জিনিসপত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র একেবারে আলাদা করে রাখতে হবে।
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহার করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে কোনোভাবেই যেন সেখানে ময়লা বা নোংরা জল জমে না থাকে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যাবহৃত শৌচাগার নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে খোলামেলা ও পরিষ্কার বিছানায় রাখতে হবে।