কাজের চাপ মানুষের শারীরিক সমস্যার সাথে সাথে মানসিক সমস্যাও তৈরি করে।আজ আমরা কাজের চাপ দূর করার সহজ উপায় সম্পর্কে জানাবো যা সঠিক ভাবে মেনে চললে সুফল আসবে আপনার কর্মজীবনে।
রোজকার দশটা-পাঁচটা অফিস হোক বা কর্পোরেট সেক্টরের টানা ন’-দশ ঘণ্টার শিফট বা হালফিলের কাউন্টলেস ওয়ার্ক ফ্রম হোম, দিনের বেশিরভাগ সময়টাই আমাদের কাটে কাজের দুনিয়ায়। তাই যাতায়াতের ধকল হোক বা বাড়ির কাজ সামলে টানা আট দশ ঘন্টার অফিস ওয়ার্ক, উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা জীবনের সঙ্গে না চাইতেও জড়িয়ে পড়েছে। কাজের চাপের সাথে সাথে বহু ক্ষেত্রেই চাকরি টিকিয়ে রাখার অদম্য লড়াই, আর তার সাথে সাথেই আসছে প্রবল মানসিক চাপ। ফলস্বরূপ রাতের পর রাত ঘুম নেই, ব্যহত হচ্ছে ব্যক্তিগত জীবন। ‘আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোশ্যাল সায়েন্স’-এর সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে কর্মক্ষেত্রে কাজের অত্যাধিক চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ।
কর্মজীবনের এই প্রবল চাপ প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত করছে ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনকে। বেশিরভাগ মানুষই এই সমস্যার ক্ষতিকর দিকটা বুঝলেও, বুঝে উঠতে পারছেন না কিভাবে সামলে উঠবেন কর্মজীবনের এই চাপ। কিভাবে ব্যালেন্স করবেন কর্মক্ষেত্র এবং ব্যক্তিগত জীবনকে। ছোট হোক বা বড়, যে কোনও সংস্থাতেই কাজের চাপ থাকে। আমরা বহু ক্ষেত্রেই ঠিকঠাক ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’ করে উঠতে পারি না। আর তার প্রভাব পড়ে কাজের ক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী ও সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, প্রোমোশনের প্রতিযোগিতা ইত্যাদিও উদ্বেগ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তবে কিছু সহজ উপায় মেনে চললে এই চাপ কিন্তু কাটিয়ে ওঠা যায় অনেকাংশেই। এমনকি অফিসে গিয়ে বরাদ্দ সময়ের মধ্যেই সেরে ফেলা যায় সব কাজ।কাজের চাপ দূর করার সহজ উপায়গুলি হল-
1. বি পজিটিভ
সবসময় পজিটিভ চিন্তাভাবনা করুন। নেতিবাচক চিন্তা আপনাকে আরও বেশি করে চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়। কিন্তু যদি হাজারো সমস্যার মধ্যেও আপনি পজিটিভ চিন্তা করতে পারেন, মনে রাখবেন আপনি নিজেই অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবেন। পজিটিভ থাকলে অবশ্যই স্ট্রেসমুক্ত জীবনযাপন করতে পারবেন। শারীরিক সমস্যাকেও রুখে দেওয়া সম্ভব স্ট্রেসকে হারাতে পারলে৷
2. ওয়ার্ক প্ল্যান
প্রতিদিন দিনের শুরুতেই ঠিক করে নিন আজ কোন কোন সময়ে ঠিক কোন কোন কাজটা করবেন। মনে রাখবেন বেলা গড়নোর সঙ্গে সঙ্গে একাধিক নতুন কাজের দায়িত্ব আসতেই পারে, তার জন্য আগাম মানসিক প্রস্তুতি সবসময় নিয়ে রাখুন। সেক্ষেত্রে এক এক করে নোট করে রাখুন সেই সব কাজের তালিকা। এ বার কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী ঠিক করে নিন কোনটা আগে সারবেন কোনটা পরে। কিন্তু কোনো কাজই পরের দিনের জন্য ফেলে রাখবেন না, একান্ত অসুবিধা নাহলে।
3. পর্যাপ্ত ঘুম
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ঘুমনোটা খুব জরুরি। সারাদিন কাজের ব্যস্ততায় বেশিরভাগ মানুষেরই ঘুমের জন্য সময় হয় না। তবে কোনোভাবেই রাতের ঘুম নষ্ট করবেন না। আজকাল অধিকাংশ মানুষ রাতের একটা দীর্ঘ সময় সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যয় করেন, কিন্তু মনে রাখা ভালো যেকোনো রোগ থেকে মুক্তি পেতেও ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। সব কাজের পাশাপাশি নিয়ম করে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমের জন্য রাখুন। তাহলেই আপনি স্ট্রেস থেকে রেহাই পাবেন, প্রতিদিন নতুন উদ্যমে কাজ করার শক্তি পাবেন ৷
4. টাইম ম্যানেজমেন্ট
প্রতিদিনের জমে থাকা অতিরিক্ত কাজের চাপই ধকল আর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। এর জন্য যেমন দায়ী সঠিক প্ল্যানিং এর অভাব, তেমনই দায়ী ঠিকমতো টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে না পারা। কাজের চাপ দূর করার সহজ উপায় হল টাইম ম্যানেজমেন্ট ।প্রতি দিনের কাজ সে দিনই সেরে ফেলার চেষ্টা করুন। অহেতুক কাজ জমিয়ে রেখে দেবেন না৷ অনেক সময়ই নিজেদের আলস্য বা গাফিলতিতে আমরা এমনটা করে থাকি। আর খুব বেশি প্রয়োজন না থাকলে অফিসের কাজ বাড়ি নিয়ে যাবেন না। বাড়িতে যেটুকু সময় পাচ্ছেন, তা একান্তই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটান। কাজের চাপ আর ক্লান্তি কাটিয়ে তুলতে পরিবারের সাথে কাটানো কোয়ালিটি টাইম একান্ত জরুরি।
5. আলোচনা করুন
কাজের ক্ষেত্রে কোনও বিষয় সম্পর্কে যে কোনও রকম সন্দেহ থাকলে বা কোনো কাজ ঠিকমতো বুঝতে না পারলে সঙ্গে সঙ্গে সিনিয়ারদের পরামর্শ নিন। অনেক সময় এমনটা করতে অনেকেই সঙ্কোচ বোধ করেন। তাতে যেমন কাজটাও সঠিক ভাবে হয়না আবার পরামর্শ না করার জন্য কাজে সময় ব্যয় হয় বেশি। ভুলের পর তার দায় থেকে একটা মানসিক চাপ তো জন্ম নেয়ই, এ ছাড়া ভুল ঠিক করার জন্যও ব্যয় হয় অতিরিক্ত সময়। মনে রাখবেন যেকোনো সংস্থাতেই সিনিয়ররা সবসময় তার কর্মীদের মধ্যে শেখার ইচ্ছে দেখতে চান, তাই আপনি তাদের সাহায্য নিলে তা আপনারই লাভ ৷
6. বিরতি নিন
আইটি সেক্টর সহ কর্পোরেট জগতের বহু চাকরি ক্ষেত্রেই কর্মীরা একটানা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে কাজ করেন। এঁদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই ভাবেন, একটানা বসে কাজ করে গেলে সময়ে কাজ শেষ হয়। তাই তাঁরা জায়গা ছেড়ে খুব একটা ওঠেন না। কিন্তু এই ধারণাতে সম্মতি দেন না মনোবিদরা, বারণ করছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থোপেডিক সার্জেনরাও। বরং তাঁদের মতে, এক-দু’ঘণ্টা অন্তর সিট ছেড়ে উঠুন। সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলুন, কয়েক পা হেঁটে আসুন। এতে একটানা বসে থাকার অভ্যেস থেকেও কিছুটা স্বস্তি মিলবে, কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়বে এর ফলে৷ সাথে সাথে কমবে স্পন্ডালাইটিস বা স্পাইনাল কর্ডের সমস্যাও।
7. যোগাভ্যাস
নিয়মিত যোগা করুন অবশ্যই। প্রতিনিয়ত ছুটে চলা দ্রুত গতির জীবন থেকে রোজ নিয়ম করে নিজের জন্য আধ ঘণ্টা সময় বের করে নিন, যোগা করুন, করতে পারেন ধ্যানও। নিয়মিত যোগা বা মেডিটেশন করলে, সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবেন স্ট্রেস। মুক্তি পাবেন সবরকম মানসিক চাপ থেকেই।
8. আড্ডা বা কোয়ালিটি টাইম
অফিস হোক বা বাড়ি, কাজ চলাকালীন টুকটাক হাসি-মস্করা-আড্ডা এসব যেন বাদ না পড়ে যায় জীবন থেকে। খানিক সময় ব্যয় হলেও দোষ নেই, বরং এতে কাজে গতি আসে। কিন্তু তা বলে আড্ডার জন্য কাজ বাকি রাখার মতো ভুল করবেন না। আড্ডার সময়টুকুও নিয়ন্ত্রণে রাখুন। সময়ের হিসেবটা কাজের চাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ঠিক করুন। কাজ চলাকালীন অকারণ মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সচেতন হোন। এতে বহু সময় নষ্ট হয় যা আমরা বুঝতেও পারিনা৷
9. সুষম খাদ্য
শরীর সুস্থ না থাকলে কিন্তু স্ট্রেসের সঙ্গে লড়াই করাটা মুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়৷ ইচ্ছেমতো ভাজাভুজি, ফাস্ট ফুড খাওয়া বন্ধ করুন, কারণ খাবারে ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি শরীরকে আরও দুর্বল করে তুলবে৷ সবুজ টাটকা শাকসবজি, ফল, মাছ, চর্বিহীন মাংস, ডিম, দুগ্ধজাত যেকোনো খাবার রাখুন রোজের খাদ্যতালিকায়। স্বাস্থ্যকর খাবার আপনার শরীরে শক্তি জোগাবে, কাজের প্রতি মনোযোগ বাড়বে অনেকখানি।
10. রঙে রঙে হোক রঙিন
মনে রাখবেন নির্দিষ্ট কয়েকটি রং মনকে শান্ত রাখে। নীল, সবুজ, সাদা, গোলাপি, হালকা বেগুনির মতো কয়েকটি রং স্ট্রেস কমাতে দারুণ কার্যকরী৷ সম্ভব হলে অফিসের ডেস্কে কিছু গাছপালা রাখুন, দেখবেন মানসিক স্থিতি অনেকাংশেই আয়ত্তে আসবে৷