মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা বহুসত্তা কী সেই সম্পর্কে আমরা অনেকেই অজ্ঞাত।এই রোগের কারণ, কী কী লক্ষণ দেখে বুঝবেন এবং রোগীর চিকিৎসা করবেন কীভাবে তা সবই বিস্তারিতভাবে জানানো হল।
একজন মানুষের শারীরিক গঠন, মুখাবয়ব যেমন তাকে বাকি সবার থেকে আলাদা করে, ঠিক তেমনই একজন মানুষের সত্তাও তাঁকে বাকিদের থেকে পৃথক করে তোলে৷ কিন্তু পৃথিবীতে এমন মানুষও আছেন যারা দুই বা ততোধিক সত্তার অধিকারী। এরকম ক্ষেত্রে সাধারণত দুই বা তিন সত্তার অধিকারী হয় আক্রান্ত রোগী৷ তবে সর্বাপেক্ষা ১০০ টি ভিন্ন সত্তা বাস করতে পারে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে। ডাক্তারি পরিভাষায় এর নাম ‘মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’ বা ‘ডিসোসিয়েটিভ পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’। এখনও গ্রামীণ এলাকা গুলিতে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় বলতে গেলে ভূতে ধরেছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে এটি একটি মানসিক রোগ, যেখানে কোনো মানুষ দুই বা তার অধিক সত্তা অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন সত্তার অধিকারী হন৷
মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার আসলে কী?
আমরা অনেক সময়ই কথা বলতে বলতে বা কাজ করতে করতেই হঠাৎ কোথাও হারিয়ে যাই, যাকে পোশাকি ভাষায় দিবাস্বপ্ন বলা হয়। কিন্তু মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা Dissociative Identity Disorder দিবাস্বপ্ন থেকে অনেক বেশি মাত্রায় প্রকট, যার ফলে মানুষের চিন্তাভাবনা ও অন্যান্য কাজের সাথে তার একটি বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। এই রোগে একজন মানুষের মধ্যে একাধিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। হতে পারে সেটি কোনো কাল্পনিক চরিত্রের,বা জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া খুব প্রিয় কেউ! আক্রান্ত মানুষটি অনেকগুলো সত্ত্বার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, নিজেকে আর আলাদা করতে পারে না। ফলে সৃষ্টি হয় বিচ্ছিন্ন সত্তা। এই বিচ্ছিন্ন সত্তা গুলি রোগীকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এবং যখন সে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, নিজের অন্য সত্তা গুলি সম্পর্কে তার কিছু মনেও থাকে না, তার মনে হয় সে কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল। একে সাইকোলজির ভাষায় ‘ব্ল্যাক আউট’ বলা হয়। একজনের মাঝে দুই বা তার অধিক ব্যক্তিত্বও দেখা যায়। এর সংখ্যা হতে পারে সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বাধিক ১০০ । তাই একে ‘মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’ও বলা হয় । ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার (Dissociative Identity Disorder) নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক, মতবাদ এবং কুসংস্কার। গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত এলাকা গুলিতে আজও এই রোগে আক্রান্ত হলে বলা হয় ভূতে ধরেছে বা প্রেতাত্মা ভর করেছে। এসব থেকে মুক্ত করতে নানাভাবে শারীরিক অত্যাচারও করা হয় রোগীকে।
মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা বহুসত্তার কারণ কী?
অনেক সময় অতীতের কোনো ভয়ঙ্কর স্মৃতি থেকে রক্ষা পেতে রোগী অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন সত্তা বা ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যে তৈরি করে নেয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শৈশবে কোনো খারাপ ঘটনা, যেমন যৌন হেনস্থা, কোনোকিছুতে প্রচন্ড ভয় পাওয়া, সামাজিক বা পারিবারিক লাঞ্ছনার শিকার হওয়া বা অতিরিক্ত মারধরের শিকার হলে, অতিরিক্ত র্যাগিংয়ের শিকার হলে, এরকম ঘটনার কোনোটি যাদের সাথে হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে পরবর্তীতে এই রোগের বিকাশ ঘটে থাকে। বিশেষ করে যারা যৌন হেনস্থার শিকার হন, তাদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশি দেখা যায়। যদিও এর প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেন , হঠাৎ প্রচন্ড ভয় থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য রোগী নিজের মাঝে নতুন ব্যক্তিত্ব তৈরি করে নেয়, যার সাথে তার অতীত,তার ভয়ঙ্কর স্মৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু উল্টোদিকে শত চেষ্টার পরও যখন সে তার ভয়ঙ্কর স্মৃতি থেকে রক্ষা পায় না, তখনই সে এই পন্থা অবলম্বন করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা তার মধ্যে এমন একটি ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে, যার বয়স তার স্মৃতির আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আটকে রয়েছে, এরপর আর বাড়ছে না, যার সাথে ঐ স্মৃতির কখনও মিলও থাকে না। গ্লানি ভর্তি শৈশব ছাড়াও যারা অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষণ্নতা ও অবসাদে ভোগেন যারা, তাদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ দেখা যায়। যারা নিজেদের জীবন নিয়ে অনেক বেশি হতাশ, নিজেদের জীবন যাদের পছন্দ না, তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে মুক্তির জন্য নিজেদের মধ্যে অন্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ হয়।
মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের লক্ষণ গুলি কী কী?
প্রাথমিক দিকে যখন কোনো রোগীকে শনাক্ত করা হয় তখন তার মধ্যে সাধারণত দুই থেকে চারটি সত্ত্বার শনাক্তকরণ হয়। পরবর্তীতে এর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, ১৩ থেকে ১৫, এমনকি অনেক সময় এ সংখ্যা ১০০তে গিয়েও দাঁড়ায়। প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন উদ্দীপনা রোগীকে এক সত্ত্বা থেকে অন্য সত্ত্বায় নিয়ে যায়। মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের রোগীদের নিয়ে বেশ জটিলতা দেখা যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার (Dissociative Identity Disorder) এর রোগীদের বেশ কিছু অন্যান্য মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়। এই রোগের কিছু লক্ষণ হলো —
১. রোগীর একটি সত্তা অন্য সত্তা বা ব্যক্তিত্ব গুলিকে মনে রাখতে পারে না।
২. রোগী অনেক সময়ই অনুভব করে তার সত্তা তার শরীর থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
৩. সে তার ব্যক্তিগত জিনিসগুলো ভুলে যেতে থাকে, যা সাধারণত ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
৪. আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়৷প্রচুর পরিমাণে হতাশা বাড়তে থাকে।
৫. ঘন ঘন মুড সুইং হয়।
৬. ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।যেমন- ঘুম না আসা, ঘুমের মাঝে ভয় পাওয়া, ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটা ইত্যাদি ।
৭. প্রচন্ড রকম অস্থিরতা, প্যানিক অ্যাটাক এমনকি বিভিন্ন ধরনের ফোবিয়াও লক্ষ্য করা যায়।
যেমন- খুব পুরনো কোনো স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়া এবং সেগুলোর প্রতি বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া।
৮. বেশ কিছু ক্ষেত্রে ড্রাগ আসক্তি অব্ধি দেখা যায়।
৯. খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম থাকে।কখনও কখনও টানা কয়েকদিন না খেয়ে থাকে।
১০. রোগী প্রচন্ড রকম হ্যালুসিনেট করতে থাকে।
সত্যিই কি এমনটা হয়?
আসলে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের শনাক্তকরণ খুব কঠিন একটি কাজ। বর্ডার লাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার সহ অন্য বেশ কিছু রোগের সাথে এর মিল থাকার কারণে অনেকেই এই রোগকে সেই সমস্ত রোগের লক্ষণ ভেবে থাকেন। বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় অনেকের মধ্যেই, তাই বহুক্ষেত্রেই মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার সঠিক সময়ে ধরা পড়ে না৷
রোগের জটিলতা কতখানি?
পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাধারণ মানুষের মধ্যে মাত্র ০.০১% থেকে ১% এ রোগে আক্রান্ত। মহিলাদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায়। মানসিক বিচ্ছিন্নতার নিরিখে দেখলে প্রায় ১ তৃতীয়াংশ মানুষ দাবী করেন, তারা নিজেকে অন্য চরিত্রে অনুভব করছেন এবং সম্পূর্ণ অন্য জগতে দেখছেন! অন্যদিকে প্রায় ৭% মানুষের ক্ষেত্রে কোনো সনাক্তকরণ ছাড়াই বোঝা যায় যে তারা মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত।
মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার থেকে মুক্তির উপায়
যেকোনো মানসিক রোগের মতোই মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার থেকে মুক্তির প্রধান উপায় হলো সচেতনতা। জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার মানুষের মধ্যে এই রোগ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে৷ তাদের বোঝাতে হবে ভূতে ধরা বা প্রেতাত্মা ভর করা এসব কিছু নয়, এটা একটা মানসিক রোগ, চিকিৎসা করলেই সেরে যাবে৷ প্রয়োজন হলে আইন প্রণয়ন করে ‘ভূত ছাড়ানো’র নামে রোগীর উপর শারীরিক অত্যাচার বন্ধ করতে হবে৷ আশেপাশের মানুষের সাহচর্য এবং সঠিক চিকিৎসাই রোগ মুক্তির উপায়।
মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা
মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের চিকিৎসায় মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বিচ্ছিন্ন সত্তা গুলিকে একটি সত্তায় একীভূত করা। একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা Dissociative Identity Disorder এর প্রকোপ থেকে মুক্তি মিললেও, তা কখনই সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য নয়। তাই এই রোগে আক্রান্ত হলেও, সুস্থ ভাবে বাঁচার জন্য নিয়মিত মানসিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকাটাই এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা। মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এর কিছু কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি হলো — টক থেরাপি(Talk Therapy), সাইকোথেরাপি (Psychotherapy), হিপনোথেরাপি (hypnotherapy) ইত্যাদি৷ মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডাররের নির্ধারিত কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি নেই । কিছু ওষুধ ডাক্তাররা অনেক সময় খেতে পরামর্শ দেন, যেমন —
Anti-anxiety medications
Anti-psychotic drugs
Antidepressants
কোনো মানুষ মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হলে, উপসর্গ হিসেবে তার মধ্যে যে রোগগুলো দেখা দেয়, যেমনঃ ডিপ্রেশন, অস্থিরতা, মেন্টাল ট্রমা — এগুলোর চিকিৎসার মাধ্যমে এবং নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এর থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যায়।