বয়সের হিসেব যাইহোক, মাথা ঘোরা বা ভার্টাইগোর কবলে পরতে হয়েছে প্রায় সবাইকেই ৷ এই ভার্টাইগো বা মাথা ঘোরা কমানোর উপায় বিভিন্ন ব্যায়ামেই আছে তা আমরা অনেকেই জানিনা।
কি এই ভার্টাইগো?
ভার্টাইগো এমন একটি অবস্থা যেখানে আক্রান্ত রোগী মনে করেন যেন তার মাথার সাথে সাথে তার চারপাশের পরিবেশটি ঘুরছে বা সেগুলি ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থাতে ভার্টাইগো আক্রান্তের ভারসাম্য হারাবে, সহজভাবে দাঁড়ানো বা হাঁটাচলা করাও কঠিন করে তুলবে। ভার্টাইগো বর্ণনা করার সবচেয়ে ভালো উপায় হ’ল আপনার শরীরকে বেশ কয়েকবার ঘোরানো এবং তার ফলে যে অবস্থাটির সৃষ্টি হয়, তা অনুভব করা।
মনে রাখবেন, ভার্টাইগো কোনও রোগের নাম নয়। তবে, লক্ষণগুলির সংকলন যা হঠাৎ করে বা একসাথে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী হতে পারে।
ভার্টাইগো মূলত দুই প্রকার, যার মধ্যে ৯৩% ক্ষেত্রে দেখা যায় আক্রান্ত রোগী পেরিফেরাল ভার্টাইগো দ্বারা আক্রান্ত।
লক্ষণ গুলি কি কি হতে পারে?
এই রোগে সাধারণত যে লক্ষণগুলি দেখা যায়, সেগুলো হলো মাথা ঘোরা, মাথা সহ সমগ্র শরীরে দুলুনি এবং শরীরের ভারসাম্য হ্রাস পাওয়া। এই লক্ষণগুলি সহ আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়শই বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, অত্যধিক ঘাম, মাথা ব্যথা, কখনও কখনও nystagmus (অস্বাভাবিক চোখের চলাফেরা), কান বন্ধ (টিনিটাস) এবং পড়ে যাওয়ার উদ্রেক এই সমস্ত অনুভূতি অনুভব করতে শুরু করবে। সাধারণত, এই রকম অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না, তবে শারীরবৃত্তীয় প্রকারভেদে কয়েক মিনিট, কয়েক ঘন্টা বা এমনকি কয়েক দিন স্থায়ী হতে পারে।
তবে অবস্থার উন্নতি না হলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। চিকিৎসক সাধারণত আপনার লক্ষণ জিজ্ঞাসা করবেন, একটি বা একাধিক পরীক্ষা করে দেখবেন এবং প্রয়োজনে আরও পরীক্ষার পরামর্শ দেবেন। বিশেষত এই সমস্ত অনুভূতি যদি আপনি প্রায়শই অনুভব করেন। এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর মেডিকেল হিস্ট্রি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাহলে সমাধান কি?
এই রোগের চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা সাধারণত ওষুধ এবং ব্যায়ামকেই সবচেয়ে কার্যকরী বলে মনে করেন । কোনো কোনো ক্ষেত্রে থেরাপি বা সার্জারির প্রয়োজন হতেও পারে৷
ব্যায়াম কি বাড়িতেই সম্ভব?
ডাক্তার রা এই রোগের চিকিৎসা হিসেবে মূলত চারটি ব্যায়াম করতে বলেন৷ এই সবগুলিই বাড়িতেই অন্তত সহজ ভাবে করা যায়। আর এই ব্যায়াম গুলি করার জন্য কোনো প্রকার যন্ত্রেরও প্রয়োজন হয় না৷
এই ব্যায়াম টি প্রতিদিন ঘরে বসে প্র্যাকটিস করলে ভার্টাইগোর সমস্যা অনেকাংশেই কমে যায়। মনে রাখবেন এই ব্যায়াম টি করার সময় হঠাৎ করে মাথা ঘোরার উদ্রেক হতে পারে, তাই অবশ্যই নিরাপদ জায়গায় করবেন ৷
- একটি সমান জায়গায় বসে আপনার পা দুটি কে এমন ভাবে রাখবেন, যেন সেইসময় আপনার শারীরিক আকৃতি একটি চেয়ারের মতো হয়।
- এবার মাথা টিকে যথাসম্ভব বাঁদিকে ঘোরান আর তারপর মাথা এবং শরীর উভয়ই ডান দিকে করে শুয়ে পড়ুন ৷ পা কিন্তু নড়বেনা। এই অবস্থায় ৩০ সেকেন্ড থাকুন ৷
- এবার বসে মাথা টিকে আস্তে আস্তে প্রাথমিক অবস্থায় নিয়ে আসুন ৷
- একইভাবে বিপরীত দিকেও করুন ৷
Semont Maneuver
বিনাইন পারঅক্সিজমাল পজিশানাল ভার্টাইগো থেকে মুক্তির জন্য একটি অন্যতম ব্যায়াম হলো Semont Maneuver। অন্যান্য ব্যায়ামের তুলনায় এটি সম্পাদন করতে কম সময় লাগে৷ তবে এই ব্যায়াম টি করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন ৷
যদি বাঁ কানে BPPV র সমস্যা থাকে, তাহলে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এই ব্যায়ামটি করবেন ৷
- বিছানার যেকোনো একটি ধারে লম্বা ভাবে সোজা হয়ে বসবেন৷
- মাথা টিকে এবার ৪৫° কোণে ডান দিকে ঘোরাতে হবে।
- মাথা কে বাঁদিকে করেই আস্তে আস্তে বিছানায় শুয়ে পড়ুন৷ এবং এই অবস্থাতেই এক মিনিট অপেক্ষা করুন৷
- এরপর একবারে আপনার সমগ্র শরীরটিকে ডান দিকে ঘুরিয়ে দিন, কিন্তু মাথাটির কৌণিক অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবেনা। (আপনার দৃষ্টি এই সময় মেঝের দিকে থাকবে)
- এই অবস্থায় এক মিনিট অপেক্ষা করে পুনরায় প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে আসুন৷
আপনার BPPV র সমস্যা যদি ডান কানে থাকে তাহলে মাথাটিকে প্রথমে বাঁদিকে নিয়ে সমগ্র শরীরকে ডানদিকে ঘোরাবেন ৷
এই ব্যায়ামটি করার পর ১০ মিনিট বসে বিশ্রাম নিন ৷ পেরিফেরাল ভার্টাইগোর সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিন একবার করে এই ব্যায়ামটি প্র্যাকটিস করুন।
Epley Maneuver
সাধারণত বিনাইন পারঅক্সিম্যাল পজিশনাল ভার্টাইগো থেকে মুক্তির জন্য ডাক্তাররা এই উপায় টি অবলম্বন করতে বলেন ৷ বাড়িতে বসে খুব সহজেই করা যায় এই প্র্যাকটিস।
ব্যায়াম কিভাবে করবেন?
- একটি সমান্তরাল জায়গায় সোজা হয়ে পিছনে বালিশ দিয়ে শুয়ে পড়ুন।
- পা দুটো কে একদম সোজা করে দিন।
- এবার মাথাটাকে আস্তে আস্তে ডানদিকে ৪৫° কোণে ঘোরান।
- মাথা টাকে ওভাবে উঁচু রেখে বালিশ দিয়ে সাপোর্ট দিন এবং এভাবে ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন ৷
- এবার পুরো ৯০° কোণে মাথা টাকে ডানদিকে নিয়ে যান, কিন্তু ঘাড় নাড়াবেন না।
- এবার সম্পূর্ণ শরীরের শক্তি দিয়ে মাথা সহ শরীর কে বাঁদিকে করুন ৷
- এবার ধীরে ধীরে প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে সামনে তাকিয়ে সোজা হয়ে উঠে বসুন।
মনে রাখবেন, এই ব্যায়ামটি তখনই করবেন, যদি আপনার ভার্টাইগোর সমস্যা ২৪ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হয়৷ সেক্ষেত্রে প্রতিদিন একবার করে এই ব্যায়ামটি অভ্যেস করুন।
Foster Maneuver
এই ব্যায়ামটিকে অর্থাৎ Foster Maneuver কে Half Somersault Exercise ও বলা হয়ে থাকে।
- ক্রস-লেগড বসে থাকুন এবং কয়েক সেকেন্ডের জন্য আপনার মাথাটি সিলিংয়ের দিকে করে তাকান।
- আপনার মাথা দিয়ে মেঝে স্পর্শ করুন। আপনার চিবুকটি আপনার বুকের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন যাতে মাথাটি স্পর্শ করে বাঁ হাঁটুতে প্রবেশ করে। এবার 30 সেকেন্ডের জন্য অপেক্ষা করুন।
- এবার এই অবস্থায়, আপনার মাথাটি ৪৫° কোণে কানের দিকে ঘুরিয়ে নিন যেদিকের কানে আপনার সমস্যা আছে৷ (অর্থাৎ যদি আপনার বামদিকে মাথা ঘোরায় বলে মনে করেন, তবে আপনার মুখটি বাম দিকে নিয়ে যান)। এই অবস্থায় 30 সেকেন্ড অপেক্ষা করুন।
- এরপর দ্রুত গতিতে, আপনার মাথাটি আপনার কাঁধ এবং পিঠের সাথে অনুভূমিক না হওয়া পর্যন্ত ওঠানোর চেষ্টা করুন। আপনার মাথা 45 ডিগ্রি কোণে রাখুন। এভাবে 30 সেকেন্ড অপেক্ষা করুন।
- এরপর মাথা উঠিয়ে সোজা হয়ে বসুন, এরপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান।
দিনে চার থেকে পাঁচবার এটি করতে পারেন। তবে প্রতিবারের মধ্যে যেন অন্তত ১৫ মিনিটের পার্থক্য থাকে।
এক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। যেমন কোনো ব্যায়ামই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া করবেন না৷ সঠিক ডায়েট, এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ জল অবশ্যই খান প্রতিদিন ৷ ব্যায়ামের প্রতিটা মুভমেন্টের মাঝে ৩০ সেকেন্ড সময় অবশ্যই রাখুন। মনে রাখবেন রোগ নির্ণয় না হওয়া অব্ধি এই ব্যায়াম কখনোই করবেন না৷ BPPV ব্যাতীত অন্য কোনো কারণে আপনার মাথা ঘোরার সমস্যা হলে, সেক্ষেত্রে এই ব্যায়াম আরও খারাপ ফল দিতে পারে৷