বর্তমান সময়ে দাড়িয়ে থাইরয়েডের সমস্যা খুবই সাধারণ বলা যায় কিন্তু হাইপোথাইরয়েডিজম কী সেটা সম্পূর্ণ ভাবে অনেকেই জানেন না। এখনো অবধি অনুমান করা যায় বয়সের যেকোনো ভাগে প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষের মধ্যে থাইরয়েডঘটিত সমস্যা দেখা গেছে। মহিলাদের মধ্যে পুরুষদের তুলনায় থাইরয়েড এর সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাছাড়া বয়সের যেকোনো প্রান্তেই থাইরয়েডের সমস্যা দিতে পারে এবং বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সমস্যা খানিক বাড়তে পারে।
সাধারণত থাইরয়েড হরমোন শরীরে শক্তি সরবরাহ, পুষ্টি বৃদ্ধি, বিপাকীয় হার বজায় রাখতে সাহায্য করে। যখন এই হরমোনের নিঃসরণ অতিরিক্ত বেশি বা কম পরিমানে হয় তখন বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়। থাইরয়েড হরমোন যখন স্বাভাবিকের তুলনায় কম পরিমানে নিঃসৃত হয় তখন তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে যা বিপাকীয় ক্ষমতা হ্রাস করে এবং পুষ্টি বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।
হাইপোথাইরয়েডিজম কী?
থাইরয়েড গলার কাছে অবস্থিত প্রজাপতি আকারের ছোট একটি গ্রন্থি যার থেকে নিঃসৃত হরমোন দেহের পুষ্টি এবং বিপাকীয় কার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। মস্তিষ্কে অবস্থিত পিট্যুইটারি গ্রন্থি যা থেকে নিঃসৃত থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন থাইরয়েড গ্রন্থিকে বার্তা পাঠায় এবং সেখান থেকে থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয়। এমন অনেকসময় হয় যখন TSH এর মাত্রা বেশি হয় তখন থাইরয়েড হরমোন কম পরিমানে নিঃসৃত হয়, একে প্রাইমারী হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়। কিছু সময় TSH এর মাত্রা কমে আসে ফলে থাইরয়েড গ্রন্থি উত্তেজিত হয়না, এবং অধিক পরিমানে থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয়না একে সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়েডিজম বলে।
এর বিভিন্ন লক্ষণ মাঝে মাঝে দেখা যায় তখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত, যেমনঃ
হাইপোথাইরয়েডিজম-এর লক্ষণ
- ক্লান্তি অনুভব হওয়া
হাইপোথাইরয়েডিজম-এর সাধারন উপসর্গ হল ক্লান্তিভাব অনুভূত হওয়া। থাইরয়েড হরমোন দেহে শক্তির ভারসাম্য বজায় রেখে সাড়া শরীরে শক্তি সরবরাহ করে। থাইরয়েড হরমোন TSH হরমোনের থেকে বার্তা পেয়ে শরীরকে স্বাভাবিক উপায়ে চালিত করে। তবে দেখা যায় যাদের থাইরয়েড হরমোন বেশি নিঃসৃত হয় তারা স্বভাবে ভীতিগ্রস্ত হয় আবার অন্যদিকে যাদের থাইরয়েড হরমোন কম থাকে তারা অনেকবেশি ক্লান্ত এবং কুঁড়ে হয়। সমীক্ষায় দেখা যায় কম থাইরয়েড হরমোনের কারনে মানুষ শারীরিকভাবে ক্লান্ত এবং কিছু ক্ষেত্রে মানসিক ভাবেও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে, যে কারনে ঘুম বেশি পায় এবং কাজের প্রতি অনিহা দেখা যায়। অর্থাৎ যদি কেউ পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরেও ক্লান্তি বোধ করে এবং বেশীক্ষণ ধরে ঘুমানোর প্রয়াস করে তাহলে তার হাইপোথাইরয়েডিজমআছে বলে ধরে নিতে হয়।
- ওজন বৃদ্ধি
অকারনবশত যদি তরতর করে ওজন বেড়ে যায় তাও কম সময়ের মধ্যে তাহলে তা হাইপোথাইরয়েডিজম-এর লক্ষণ বলে ধরা নিতে হয়। সহজভাবে বলা যায়, খাদ্য থেকে প্রাপ্ত শক্তির একমাত্র একক হল ক্যালোরি, থাইরয়েড এই ক্যালোরি পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করে ও সারা দেহে সরবরাহ করে এবং যার ফলে দেহের পুষ্টি বৃদ্ধি হয়। কিন্তু এই থাইরয়েড হরমোন যদি কম পরিমানে নিঃসৃত হয় তাহলে তা বিপাকীয় ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে কাজে লেগে যায়, ফলত অতিরিক্ত ক্যালোরি যা খাবারে থাকে তা বিনষ্ট হয়না এবং স্নেহপদার্থ বা ফ্যাট রুপে দেহে জমা হতে থাকে। এভাবেই দেহের স্বভাবিক ওজন ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে । সমীক্ষায় দেখা যায়, হাইপোথাইরয়েডিজম-এর কারণে বছরে একজনের ৭-১৪ কিলোগ্রাম ওজন বৃদ্ধি হতে দেখা যায়। যদি কারোর সঠিক ডায়েট মেনে চলার পরও দেহের ওজন অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- ঠাণ্ডা–ভাব অনুভূত হওয়া
গরম লাগা বা এক্সারসাইজ করার সময় ঘাম দেওয়া হল ক্যালোরি বিনষ্ট হওয়ার একটি লক্ষণ, এমনকি চুপচাপ বসে থাকলেও অনেকসময় গরম লাগে বা ঘাম দেয় তার মানে তখন অল্প পরিমান হলেও ক্যালোরি ধ্বংস হয়। হাইপোথাইরয়েডিজমে দেহের মূল বিপাকীয় হার বা বেসাল মেটাবলিক রেট কমে আসে যা শরীরে কম পরিমানে তাপ উৎপন্ন করে, ফলত দেহ ঠাণ্ডা অনুভব করে। এছাড়া থাইরয়েড হরমোন শরীরে ব্রাউন ফ্যাট উৎপন্ন করে যা শরীরে তাপ উৎপাদন করতে সাহায্য করে। কিন্তু হাইপথাইরয়েডিজমে কম পরিমানে থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হওয়ার জন্য ব্রাউন ফ্যাট তৈরি হয়না ফলে দেহ ঠাণ্ডা অনুভব করে।
- পেশীতে এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যাথা
থাইরয়েড হরমোন কম নিঃসৃত হলে মেটাবলিসমের হার কমে আসে এবং তা ক্যাটাবলিসমে পরিনত হয় ফলে পেশীর জোর কমে আসে ও শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। হাইপোথাইরয়েডিজম যাদের আছে তাদের সপ্তাহে ১-২ বার স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি দুর্বল অনুভব হয়, গা ম্যাজম্যাজ করে, পেশীতে খিঁচ ধরে, অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে ব্যাথা ইত্যাদি হতে দেখা যায়।
- চুল ঝরে যাওয়া
অন্যান্য কলাকোশের মতো চুলের মধ্যে থাকা ফলিকলস থাইরয়েড হরমোন দ্বারা প্রভাবিত হয়। থাইরয়েড হরমোনের পরিমান কম হলে চুলের ফলিকলস নতুন ভাবে তৈরি হতে পারেনা ফলে চুল ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করে। প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ থাইরয়েড রোগীর মধ্যে এই লক্ষণ দেখা যায়।
- শুষ্ক ত্বক এবং চুলকানি
চুলের মতই ত্বকে একটা জায়গা ক্ষত হলে সেখানে আবার নতুন কোশ তৈরি হয়ে যায়, কিন্তু এই থাইরয়েড হরমোন যদি তার স্বাভাবিক চক্রের বাইরে ক্রিয়া করে অর্থাৎ পরিমানে কম নিঃসৃত হয় তাহলে ত্বকের কোশগুলি পুনরায় তৈরি হতে সময় বেশি নেয়, যার কারণে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং চুলকানি হতে পারে। যাদের হাইপোথাইরয়েডিজম থাকে তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিগত বছর ধরে স্কিন ড্রাই হয়ে যায় এবং ঘা, লাল ভাব, হাঁজা ইত্যাদি হতে দেখা যায় একে মিক্সেডেমা বলে।
- ভুলে যাওয়া
অনেক হাইপোথাইরয়েডিজম রোগীদের মধ্যে স্মৃতি লোপ পাওয়া বা কথা মনে রাখতে না পারা এই ধরনের সমস্যা হতে দেখা যায়। অনেকসময় বিশেষ কিছু জিনিসে মনঃসংযোগ করতে অসুবিধা হওয়াও হাইপোথাইরয়েডিজম-এর লক্ষণ।
হাইপোথাইরয়েডিজম অনেক ক্ষেত্রে অবসাদ বা ডিপ্রেশনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর কারণ সঠিক ভাবে বলা যায়না তবে ধরে নেওয়া যায় যে কারণে থাইরয়েড হরমোনের পরিমান কম হলে শরীরে শক্তি কমে আসে বা দুর্বল অনুভব হয়, সে কারনেই মানুষ অবসাদে ভোগেন। হয়তো দেখা যায় কাজের পর শরীর এতটাই ক্লান্ত হয়ে যায় যে বিভিন্ন সামাজিক বন্ধন থেকে দূর হয়ে যেতে হয়, ফলে একাকীত্ব তৈরি হয়। আর এই একাকীত্ব থেকে অবসাদ, মন খারাপ, যেকোনো জিনিসের প্রতি অনিহা ইত্যাদি তৈরি হয়। বাচ্চা প্রসবের পর হরমোন ওঠানামা করা হাইপোথাইরয়েডিজমের অন্যতম কারণ, এবং যার থেকে পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন তৈরি হতে পারে।
- অতিরিক্ত বা অনিয়মিত পিরিয়ড
সাধারণত থাইরয়েড হরমোন ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড নিয়ন্ত্রিনকারী হরমোনগুলির সাথে মিলিত হয়। এবার যদি কম পরিমানে থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয় তার প্রভাবে অনেকসময় দেরিতে বা অনিয়মিত সময়ে পিরিয়ড হতে দেখা যায়। এছাড়া থাইরয়েড হরমোন ওভারি এবং ইউটেরাসেও সরাসরি প্রভাব ফেলে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য
থাইরয়েড হরমোন কম নিঃসৃত হলে কলনে একটা চাপ সৃষ্টি হয়, ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং তার থেকে পেটে চাপ বা ব্যাথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি হতে দেখা যায়। হাইপোথাইরয়েডিজম রোগীদের মধ্যে প্রায় ১৭-১৮ শতাংশের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য বা কন্সটিপেশন এর মত সমস্যা হতে দেখা যায়।