মেনোপজ হল মহিলাদের পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার একটি স্বাভাবিক শারীরিক ঘটনা।সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবনযাত্রায় পাল্টেছে অনেককিছুই। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের সময়ের সাথে তুলনা করলে বেড়েছে বিয়ের গড় বয়সও। কেরিয়ার বা অন্যান্য সামাজিক অথবা নিছক ব্যক্তিগত কারণেই, সন্তান ধারণের ক্ষেত্রেও বেশি হয়ে যায় বয়স। হয়ত তাই একসময় হঠাৎ করেই চলে আসে মেনোপজের সময়৷ শুধু তাই নয় বর্তমানে বহু মহিলারাই সম্মুখীন হন প্রি ম্যাচিওর মেনোপজের৷ অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ের আগেই। অনেকই ভাবেন এতে শারীরিক সম্পর্ক শেষ করে দিতে হয়। মানসিক দিকে দিয়েও অনেকে পিছিয়ে পড়েন অনেকেই। চলে আসে মানসিক অবসাদ, অ্যাংজাইটি। কিন্তু এই ভাবনা সম্পূর্ণভাবেই মানসিক। একেবারেই শারীরিক নয়, যেমনটা সকলে ভাবেন। তবে আসতে পারে ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস, বা চুলকানি। তবে মেনোপজের পর শারীরিক সম্পর্কে বা লিবিডোতে সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা সম্ভব।
মেনোপজ (Menopause) কী?
ঋতুচক্র বা ঋতুস্রাব নারীদের প্রজননক্ষম জীবনকালের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই চক্র সাধারণত ২৮ দিন অন্তর পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। ঋতুচক্রের মাঝামাঝি সময়ে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়। যৌনমিলনের ফলে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু মিলিত হলে তা থেকে জাইগোট গঠিত হয়ে, পরবর্তীতে তা থেকে ভ্রূণ উৎপন্ন হয়। কিন্তু জরায়ুতে শুক্রাণু সঠিক সময়ে না পৌঁছাতে পারলে, ডিম্বাণু নষ্ট হয়ে যায় এবং জরায়ুর ভিতরের দেওয়াল থেকে এন্ডোমেট্রিয়াম স্তরটি ভেঙে পড়ে। ফলত এই চক্রের শেষের দিকে রক্ত মিশ্রিত তরল, মিউকাস, ভগ্ন কোষস্তর টানা কয়েকদিন যোনিপথ দিয়ে নির্গত হতে থাকে। এই ক্ষরণকেই বলা হয় রক্তস্রাব বা রজঃস্রাব বা প্রচলিত কথায় ঋতুস্রাব।
কিন্তু একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে যায়। তখন আর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুর নিঃসরণ হয় না, ঋতুস্রাবও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়টাকেই বলা হয় মেনোপজ। তবে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াটি আবার হঠাৎ করে হয় না। ৫-৭ বছর যাবত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। শারীরিক ভাবে প্রজননক্ষম একজন নারীর প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার এই পুরো সময়কালকে বলা হয় Climacteric.
স্বাভাবিক মেনোপজের বয়সসীমা কী?
মেনোপজের বয়সসীমা সবার ক্ষেত্রে এক হয় না। ডাক্তারদের মতে গড় বয়স ৫০ বছর ধরা হলেও ৪০-৫০ বছর বয়সের মধ্যে যেকোনো সময় হতে পারে মেনোপজ।
সার্জারির মাধ্যমে ডিম্বাশয় কেটে বাদ দিলে অনেক কম বয়সেও মেনোপজ আসতে পারে। একে সার্জিক্যাল মেনোপজ বলা হয়। এছাড়া যাদের পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS), এন্ডোমেট্রিওসিস, থাইরয়েড বা ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা থাকে তাদের ক্ষেত্রেও মেনোপজের বয়স স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়। দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ধূমপান বা মদ্যপান করলেও অনেক সময় এরকম হতে পারে। একে প্রি-ম্যাচিওর মেনোপজ বলে।
প্রি-ম্যাচিওর মেনোপজের কী কী শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হয়?
• হঠাৎ করে কোনো কায়িক শ্রম ছাড়াই প্রচণ্ড গরম লাগতে শুরু করে, ডাক্তারি পরিভাষায় একে হট ফ্ল্যাশ বলা হয়। মুখ থেকে শুরু করে এই অনুভূতি শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রচন্ড ঘাম হয়। রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায়।
• ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস।
• ইউটিআই অর্থাৎ ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশন।
• ইউরিন ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যাওয়া।
• ক্যালসিয়ামের অভাব থেকে হাড়ের ক্ষয় অর্থাৎ অস্টিওপোরোসিস।
• প্রিম্যাচিওর মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন কমে যাওয়ায় হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
• ইস্ট্রোজেনের অভাবে ত্বকেও ড্রাইনেস আসে। ত্বকের কোমলতা হারিয়ে যায়। দেখা দেয় বলিরেখা। চুল, নখ সবকিছুই তাদের স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে।
• বন্ধ্যাত্ব
• প্রি ম্যাচিওর মেনোপজের সবচেয়ে বড় সমস্যা মানসিক সমস্যা। প্রিম্যাচিওর মেনোপজের পর মেয়েরা ভাবে, তাঁর জীবন থেকে সবকিছু হারিয়ে গেল। স্বাভাবিক যৌনজীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আর ঠিক এই কারণেই দেখা দেয় অতিরিক্ত কিছু উপসর্গ। যেমন — মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, ঘনঘন মুড সুইং, অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন ইত্যাদি।
মেনোপজ পরবর্তী সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কোন চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়?
এইচ আর টি বা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (HRT)
নারী শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের অবদান সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পর ইউটেরাইন লাইনিং নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধিতে স্তনের আকার আয়তনের পরিবর্তন, হার্ট, রক্ত, লিভার, মস্তিষ্ক ইত্যাদি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে এই হরমোন। এছাড়া হাড়ের ক্ষয় রোধ করে। মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন নিঃসরণ না হলে নানারকম সমস্যা শুরু হয়। মেনোপজ পরবর্তী এই সমস্ত সমস্যার হাত থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বা HRT। কখনও কখনও ইস্ট্রোজেনের সঙ্গে প্রোজেস্টেরন হরমোনও দিতে হয় এই থেরাপিতে ৷
উল্লেখ্য, ইস্ট্রোজেন হরমোন মূলত ওভারি থেকে নিঃসৃত হলেও নারীদের শরীরে কিছু ফ্যাটি টিস্যু এবং অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডও ইস্ট্রোজেন হরমোন তৈরি করে। তাই যেসব মহিলার ফ্যাটি টিস্যু এবং অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ড প্রিম্যাচিওর মেনোপজের পরেও সঠিক ভাবে কাজ করে তাঁদের সেভাবে কোনও সমস্যা সৃষ্টি হয় না। তাই এইচআরটিরও প্রয়োজন হয় না। তবে প্রিম্যাচিওর মেনোপজের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইচআরটি করার প্রয়োজন হয়।
বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি
ওভারির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য প্রিম্যাচিওর মেনোপজ হলে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অত্যাধুনিক রিপ্রোডাকটিভ মেডিসিনের সাহায্যে এরপরেও সন্তানধারণ সম্ভব। এক্ষেত্রে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ সহ অন্যান্য পদ্ধতি প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রেই আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়। ক্যানসারের চিকিৎসাতেও যদি ওভারির ক্ষতির আশঙ্কা থাকে এবং সেই মহিলা যদি পরবর্তীকালে মা হতে চান তাহলে কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের আগেই তাঁর ওভারি থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে ফ্রিজিং করে রাখা যায়। ওই ডিম্বাণুর সাহায্যে বায়োলজিক্যালি মা হতে পারবেন সেই মহিলা। কিন্তু ওভারি বা ইউটেরাস অস্ত্রোপচারে বাদ দেওয়া আর কখনও সন্তানধারণ সম্ভব নয়।