মলদ্বারের কাছে অবস্থিত শিরাগুলি যখন ফুলে যায় ও ব্যাথা হয়, সেই অবস্থাকে অর্শ্ব বলে। প্রায় ৫০% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই তাদের পঞ্চাশ বছর বয়সের ভেতর অর্শ্বে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
অর্শ্ব মলদ্বারের ভেতরে বা বাইরে উভয়ই হতে পারে। মলদ্বারের ভিতরে হলে তাকে ইন্টারনাল হেমরয়েড বলে এবং মলদ্বারের বাইরে হলে তাকে এক্সটারনাল হেমরয়েড বলে। হেমরয়েডকে পাইলসও বলা হয়।
এক্সটারনাল হেমরয়েড সবথেকে বেশি সমস্যা সৃষ্টি করে। হেমরয়েডের ফলে যন্ত্রণা, প্রচণ্ড চুলকানি, বসতে সমস্যা ইত্যাদি হয়ে থাকে। তবে চিকিৎসায় অর্শ্ব সারানো যায়।
অর্শ্ব রোগের লক্ষণ
অর্শ্বের রোগ লক্ষণ নির্ভর করে তার ধরণের ওপর।
ইন্টারনাল হেমরয়েডের রোগলক্ষণ হল
⦁ মলত্যাগের পর মলদ্বার সংলগ্ন অঞ্চলে রক্ত
⦁ মলত্যাগের সময় মলদ্বারের ভেতর থেকে ত্বকের অংশ বাইরের দিকে বেরিয়ে আসা
এক্সটারনাল হেমরয়েডের রোগলক্ষণ
⦁ মলদ্বারের আশেপাশের অঞ্চলটি প্রচণ্ড চুলকানি
⦁ মলদ্বারের কাছে যন্ত্রণাদায়ক ফোলা ভাব
⦁ মলদ্বারের চারপাশে যন্ত্রণা, বিশেষ করে বসার সময়
অর্শ্ব সাধারণত যন্ত্রনার সৃষ্টি করে না, তবে এক্সটারনাল হেমরয়েডের ফলে ত্বকের ওপর রক্ত জমাট বাঁধে। একে থ্রম্বোসেড হেমরয়েড বলে। ইন্টারনাল হেমরয়েডের ফলে যে ফোলাভাব তৈরি হয়, তা সাধারণত আর কমে না। এর ফলেও যন্ত্রনার সৃষ্টি হয়। যদি আপনার কখনও মলত্যাগের সাথে রক্তপাত হয় বা মলের রঙ কালো হয় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান, কারণ মলত্যাগের সাথে রক্তপাত হেমরয়েড ছাড়া অন্য কারনেও হয়ে থাকে। ঘরোয়া পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে যদি অর্শ্ব এক সপ্তাহের ভেতর না কমে তাহলেও দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
অর্শ্ব রোগের কারণ
মলদ্বারের পার্শ্ববর্তী ধমনীতে যখন অতিরিক্ত চাপ পড়ে তখন অর্শ্ব হয়ে থাকে। অর্শ্বের সাধারণ কারণ ও বিপদগুলি হল —
⦁ মলত্যাগের সময় চাপ পড়া
⦁ দীর্ঘক্ষন ধরে বসে থাকা, বিশেষত টয়লেটে
⦁ দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়ারিয়া থাকলে
⦁ পরিবারের সদস্যদের অর্শ্ব হওয়ার ইতিহাস থাকলে
⦁ নিয়মিত ভারী জিনিস তুললে
⦁ ওবেসিটি থাকলে
⦁ অ্যানাল সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স করলে, যা অর্শ্বে সমস্যার সৃষ্টি করে
⦁ গর্ভবতী অবস্থায় (ইউটেরাস যখন আকারে বড় হয়ে যায়, তখন তা কোলোনের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে)
⦁ ৫০ বছরের বেশি বয়স হয়ে থাকলে
অর্শ্বের রোগ নির্ণয়
সাধারণ ভাবে চোখে দেখেই বোঝা যায় যে মলদ্বারে অর্শ্বের সমস্যা তৈরি হয়েছে কি না। তবুও রোগ নির্ণয় সঠিক করতে চিকিৎসক আরো কিছু পরীক্ষা করতে পারেন, যে অর্শ্ব ছাড়াও অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা তা দেখার জন্য। একে ডিজিটাল রেক্টাল এক্সাম বলা হয়। চিকিৎসক এই সময় হাতে গ্লাভস পরে এবং লুব্রিকেসন ব্যবহার করে মলদ্বারে আঙুল প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করেন। রোগীর অন্যান্য গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল রোগ আছে কিনা তার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসক অ্যানোস্কোপি, সিগময়েডোস্কোপি বা কোলোনোস্কোপি করতে বলতে পারেন।এই প্রতিটি পরীক্ষাতেই চিকিৎসক একটি ছোট ক্যামেরা ব্যবহার করেন মলদ্বারের প্রবেশ পথ, মলদ্বার এবং কোলন পরীক্ষা করারা জন্য। অ্যানোস্কোপির মাধ্যমে মলদ্বার পরীক্ষা করা হয়, সিগময়েডোস্কোপির মাধ্যমে কোলোনের শেষ ২ ফিট (৫০ সেন্টিমিটার) পরীক্ষা করা হয় এবং কোলোনোস্কোপির মাধ্যমে সমগ্র কোলোনের পরীক্ষা করা হয়।
এই সমস্ত পরীক্ষায় একটি ছোট ফাইবার অপটিক ক্যামেরা একটি ছোট টিউবে ফিট করে মলদ্বারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো হয়। এর ফলে চিকিৎসক একদম কাছ থেকে অর্শ্বকে পরীক্ষা করতে পারেন।
সমস্যা
অর্শ্ব থেকে কোনো বড় রকমের সমস্যা হয় না, তবে যে যে সাময়িক সমস্যাগুলো হতে পারে, তা হল —
⦁ ফুলে থাকা ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধে
⦁ রক্তপাত
⦁ প্রায়শই রক্তপাতের ফলে অ্যানিমিয়া
⦁ এক্সটারনাল হেমরয়েডে ইনফেকশন
অর্শ্ব রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি
অর্শ্বের চিকিৎসা ঘরোয়া পদ্ধতিতে বা চিকিৎসকের পরামর্শ মতো হয়ে থাকে।
যন্ত্রণা মুক্তি — অর্শ্বের যন্ত্রণা কমানোর জন্য একটি গরম জলের পাত্রে প্রতিদিন মলত্যাগের পর অন্তত দশ মিনিট বসা প্রয়োজন। এতেও ব্যথা না কমলে ওষুধের দোকানে সাধারণ ভাবে পাওয়া যায় এমন প্রচুর অর্শ্বের অয়েন্টমেন্ট আছে, যা ব্যবহার করলে ব্যথা, চুলকানি ও অস্বস্তি কম থাকে।
ফাইবার সাপ্লিমেন্ট — যদি আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে তাহলে ফাইবার সাপ্লিমেন্ট খাওয়া যেতে পারে। দুটো খুব কমন ফাইবার সাপ্লিমেন্ট হল ইসবগুল ও মিথাইলসেলুলোজ।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে চিকিৎসা
হাইড্রোকর্টিসোন আছে এমন অর্শ্বের ক্রিম ব্যবহার করলে অর্শ্বের অস্বস্তি এবং ব্যথা কম থাকে এবং উইচ হ্যাজেল প্যাড ব্যবহার করলেও অর্শ্বের অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
প্রতিদিন ১০–১৫ মিনিটের জন্য সিটস বাথ নেওয়া খুবই উপকারী
নিয়মিত হাইজিন মেনে চলা খুবই দরকারী। প্রতিদিন স্নানের সময় বা মলত্যাগের পর গরম জল দিয়ে মলদ্বার পরিস্কার করতে হবে। সাবান ব্যবহার না করাই ভালো, কারণ সাবান অর্শ্বের অস্বস্তি কে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
মলদ্বারের ওপর ঠান্ডা সেঁক দিলে অর্শ্বে ফোলাভাব কমে, এছাড়া অ্যাসিটামিনোফেন, আইবুপ্রুফেন বা অ্যাসপিরিন ব্যবহার করলেও যন্ত্রণা ও অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
মেডিক্যাল পদ্ধতি
যদি ঘরোয়া পদ্ধতিতে কাজ না হয়, তাহলে চিকিৎসক রাবার ব্যান্ড লাইগেশন পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারেন। এর মাধ্যমে চিকিৎসক অর্শ্বের চারপাশে একটি রাবার ব্যান্ড ব্যবহারের মাধ্যমে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেন। এর ফলে অর্শ্বের ফোলা অংশটির আকার ছোট হয়ে যায়। এই পদ্ধতিটি কেবল একজন চিকিৎসকই করতে পারেন, নিজে নিজে কখনই করা উচিৎ নয়।
রাবার ব্যান্ড লাইগেশন যদি আপনার জন্য সঠিক না হয়ে থাকে, তাহলে চিকিৎসক স্ক্লেরোথেরাপির ব্যবহার করে থাকেন। এর মাধ্যমে চিকিৎসক একটি কেমিক্যাল সরাসরি ধমনীতে ইঞ্জেক্ট করেন এবং এর গলে অর্শ্বের আকৃতি ছোট হয়ে যায়।
প্রতিরোধ
অর্শ্ব প্রতিরোধ করতে সবার প্রথমে যেটা করা দরকার তা হল, মলত্যাগের সময় চাপ না দেওয়া এছাড়াও জল পানের পরিমান বাড়াতে হবে। বেশি পরিমানে জল খেলে মল অতিরিক্ত শক্ত হয়ে যাবে না।
যে মূহুর্তে মনে হবে যে মলত্যাগের প্রয়োজন, সেই মূহুর্তেই বাথরুমে যেতে হবে। দীর্ঘক্ষন একভাবে বসে থাকলে অর্শ্ব হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য নিয়মিত এক্সারসাইজ প্রয়োজন এবং এবং শক্ত জায়গায় বেশিক্ষণ ধরে বসে থাকা যাবে না।
বেশি পরিমানে ফাইবার আছে এমন খাদ্য গ্রহনের অভ্যাস করলে ভবিষ্যতে কোষ্ঠকাঠিন্য ও অর্শ্ব হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। উচ্চ মাত্রায় ফাইবার যুক্ত খাদ্য হল—
⦁ গম
⦁ ব্রাউন রাইস
⦁ ওটস
⦁ গাজর
⦁ ব্র্যান
উচ্চমাত্রায় ফাইবার যুক্ত খাদ্য মল কে নরম রাখে, ফকে সহজে মলত্যাগ হয়ে যায়।