ক্রিয়েটিনিন হল আমাদের শরীরের একটা বর্জ্য পদার্থ যা আমাদের মাংস পেশি ব্যবহারের ফলে উৎপন্ন হয়। প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন খেলেও এই পদার্থটি শরীরে উৎপন্ন হয়। রক্তের মাধ্যমে এই ক্রিয়েটিনিন কিডনিতে পৌঁছায়, যেখান থেকে আমাদের শরীর সেটা মূত্রের মাধ্যমে বের করে দেয়। কিডনি যদি সঠিক ভাবে কাজ না করে, তাহলে শরীরে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। শরীরে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে গেলে সেটা কিডনির রোগের ইঙ্গিত করে।
যে যে রোগলক্ষণ থাকলে ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করতে হবে, সেগুলো হল —
- মূত্রত্যাগের নানা সমস্যা (বারবার হওয়া, যন্ত্রণা বা রক্ত থাকা)
- পেশিতে টান
- ক্লান্তি
- গা গুলানো এবং বমি আসা
- চোখের চারপাশে ফোলা ভাব
- পায়ের পাতা এবং গোড়ালিতে ফোলা ভাব
আপনার চিকিৎসক নিয়মিত ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করতে বলতে পারেন, যদি আপনার এই সমস্যাগুলো থাকে —
- ডায়াবেটিস
- হাই ব্লাড প্রেশার
- থাইরয়েডের সমস্যা
- কিডনি তে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন
- ব্লকড ইউরিনারি ট্র্যাক
- পরিবারের অন্য সদস্যদের কিডনির অসুখ থাকে
পরিশ্রমসাধ্য এক্সারসাইজ বা sulfamethoxazole, trimethoprim বা কেমোথেরাপির ড্রাগে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এছাড়াও গর্ভবতী অবস্থা বা রেড মিট বেশি খেলেও ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়।
এবার আমরা স্বাভাবিক ভাবে ক্রিয়েটিনিন কমানোর ঘরোয়া উপায়গুলি আলোচনা করবো —
১) ক্রিয়েটিন আছে এমন সাপ্লিমেন্ট না ব্যবহার করা
ক্রিয়েটিন হল একটি জৈবিক পদার্থ যা আমাদের পাকস্থলীতে তৈরি হয়। এরপর এটি পেশিতে যায়, যেখানে শক্তির প্রয়োজনে এটি ব্যবহার করা হয়। যেটা ব্যবহৃত হয় না, সেটা ক্রিয়েটিনিন (বর্জ্য পদার্থ) এ পরিনত হয়। এর প্রাকৃতিক উৎস ছাড়াও ক্রিয়েটিন ওরাল সাপ্লিমেন্ট হিসেবেও পাওয়া যায়। কিছু অ্যাথলিট এই ক্রিয়েটিনিন যুক্ত সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করে । যাঁরা তাঁদের শরীরে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ কমিয়ে কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছেন, তাঁদের ক্রিয়েটিন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। ক্রিয়েটিন সাপ্লিমেন্ট এবং শরীরে তাদের সামগ্রিক সুরক্ষার ওপরে খুব সামান্য পরীক্ষাই হয়েছে। ডায়েটে যেকোনো পরিবর্তন করতে গেলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা খুবই জরুরি।
২) অতিরিক্ত প্রোটিন খাওয়া বন্ধ করতে হবে
অতিরিক্ত প্রোটিন ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষত রান্না করা রেড মিটের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা বেশি ঘটে। রেড মিটে থাকা ক্রিয়েটিন তাপের প্রভাবে ক্রিয়েটিনিন উৎপাদন করে । যাঁরা অতিরিক্ত রেড মিট ও দুগ্ধজাত প্রোটিন ও অন্যান্য প্রোটিন খাদ্যতালিকায় রাখেন তাঁদের ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ স্বাভাবিক ভাবেই বেশি হয়।
৩) প্রচুর পরিমাণে ফাইবার খেতে হবে
যদিও এই ব্যাপারে গবেষণার আরও প্রয়োজন আছে, তাও একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে খাবারে ফাইবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে ক্রনিক কিডনির রোগীদের ক্রিয়েটিনিন এর পরিমাণ কমানো গেছে। বিভিন্ন ফল, সবজি, দানা শস্য ইত্যাদিতে বেশি পরিমাণে ফাইবার থাকে।
৪) চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন, যে কতটা পানীয় আপনি খেতে পারবেন
ডিহাইড্রেশনের ফলে ক্রিয়েটিনিন লেভেল বেড়ে যায় আবার কিডনির রোগীদের ক্ষেত্রে ফ্লুইড ইনটেকও একটা চিন্তার বিষয়। নিজের চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন যে সারাদিনে জল ও অন্যান্য পানীয় মিলিয়ে কতটা জলীয় পদার্থ আপনি গ্রহন করতে পারেন এবং দিনের কোন সময়ে এগুলো গ্রহণ সবথেকে উপযোগী হবে।
৫) লবণ খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে
খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ হাই ব্লাড প্রেশারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রসেসড ফুডে সোডিয়াম ও ফসফরাসের পরিমাণ বেশি থাকায় তা কিডনির সমস্যা তৈরি করে। তাই সবসময় আনপ্রসেসড ফুড যা বিভিন্ন মশলা ও ভেষজ দিয়ে রান্না করা, তা খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে।
৬) NSAID এর অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করতে হবে
নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগ (NSAID), যা কিনা ওভার দ্য কাউন্টার পেন কিলারস, তা যদি অতিরিক্ত মত্রায় খাওয়া হয়, তাহলে তা কিডনির খুব ক্ষতি করে। আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। তিনি আপনার ব্যথা যন্ত্রণা কমানোর সঠিক উপায়ে চিকিৎসা করবেন।
৭) ধূমপান বন্ধ করতে হবে
ধূমপান শরীরে নানারকমের ক্ষতি করে। ধূমপান ক্রনিক কিডনি রোগের সম্ভাবনা কেও বাড়িয়ে তোলে। যদিও ধূমপান বন্ধ করলে কিডনির সমস্যা কমে যায় এবং ক্রিয়েটিনিন লেভেলও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৮) অ্যালকোহল বন্ধ করতে হবে
অ্যালকোহল নিয়ে মতবিরোধ আছে। কোনো কোনো পরীক্ষায় দেখা গেছে যে সামান্য পরিমাণ অ্যালকোহল ক্রনিক কিডনির রোগের উপশমে সাহায্য করে। আবার অন্য সমীক্ষায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত অ্যালকোহল কিডনির প্রভূত ক্ষতি করে এবং হাই ব্লাড প্রেশারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ক্রিয়েটিনিন লেভেল যদি বেশি হয় তাহলে সেটা খুবই চিন্তার বিষয়, কিন্তু জীবন ধারণের পরিবর্তন, খাওয়া, সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার ইত্যাদির পরিবর্তন করে ক্রিয়েটিনিন লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।