থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কি ?
আমাদের শ্বাসনালীর সামনে থাকে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড (Thyroid gland)। থাইরয়েড গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হয় টি৩ এবং টি৪ হরমোন। থাইরয়েড হরমোন কতটা বেরবে তা নিয়ন্ত্রণ করে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন বা টিএসএইচ। মস্তিষ্কের পিট্যুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হয় এই হরমোন যা থাইরয়েড গ্ল্যান্ডকে উদ্দীপিত করে। থাইরয়েড থেকে এরপর বেরোয় টি৩ এবং টি৪। মনে রাখতে হবে, টি৩ বা টি৪ হরমোনের ক্ষরণ বাড়লে টিএসএইচ ক্ষরণের মাত্রা হ্রাস পায়। আবার টি৩ বা টি৪-এর মাত্রা হ্রাস পেলে টিএসএইচ-এর মাত্রা বাড়ে।
থাইরয়েড হরমোনের কাজ
দৈহিক বৃদ্ধি, ব্রেনের বিকাশ, যৌন হরমোনের বৃদ্ধি, হার্টের ফাংশন ঠিক রাখার পিছনে থাইরয়েড হরমোনের বিশেষ ভূমিকা আছে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে কোনও জটিলতা তৈরি হচ্ছে মনে হলে চিকিৎসকরা সাধারণত প্রথমে রোগীর রক্তে টিএসএইচ-এর মাত্রার পরীক্ষা করান (TSH test)। টিএসএইচ ক্ষরণের মাত্রা দেখে বোঝা যায় টি৩ কিংবা টি৪ হরমোনে নিঃসরণ কমেছে বা বেড়েছে। তখন টি৩ বা টি৪ হরমোনের পরীক্ষা করাতে দেওয়া হয়। এছাড়া আলট্রাসাউন্ড করেও থাইরয়েড গ্রন্থির গাত্রে বা মূল থাইরয়েড গ্রন্থির কোনও সমস্যা আছে কি না তাও দেখা হয়।
থাইরয়েডের অসুখের নানা রোগ
থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে তিন ধরনের সমস্যা হতে পারে।
১) থাইরয়েড থেকে যে হরমোন বেরোয় সেই হরমোন ক্ষরণের মাত্রা বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে পারে। এই ধরনের সমস্যাগুলিকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলা হয়।
২) থাইরয়েডের আকার বাড়তে পারে। তা হতে পারে থাইরয়েডে টিউমার । নডিউল তৈরি হওয়ার জটিলতা থেকে।
৩) উপরিউক্ত দুটি সমস্যা একসঙ্গেও দেখা যায় কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে।
রোগ লক্ষণ :
হাইপোথাইরয়েডিজম (hypothyroidism): রক্তে টিএসএইচ-এর মাত্রা অনেক বেশি হয়। একইসঙ্গে টি৩ এবং টি৪ –এর মাত্রা কম থাকে। হাইপোথাইরয়েডিজম হলে রোগীর ওজন বাড়তে পারে। পালস রেট কমে যায়। শীতভাব বেড়ে যায়। ত্বকেও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হাইপারথাইরয়েডিজম (hyperthyroidism): টিএসএইচ মাত্রা হ্রাস পায়। টি৩ এবং টি৪-এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। হাইপারথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রমশ রোগা হতে থাকেন। চোখ যেন বড় হয়ে গিয়েছে মনে হয়। রোগী গরমে সংবেদনশীল হয়ে পড়েন। পরিবেশের সামান্য তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রবল ঘাম হয়।
চিকিৎসা: সাধারণত ওষুধ দিয়ে এই সমস্যা মেটানো যায়।
থাইরয়েডের আকার বৃদ্ধি বা টিউমার (thyroid tumor) হওয়ার উপসর্গ—
গলার কাছে ফোলা ভাব দেখা যায়। সাধারণত ইএনটি চিকিৎসকের কাছেই রোগী গলায় ওই অস্বাভাবিক ফোলা ভাব নিয়ে উপস্থিত হন। এছাড়া বিশেষ কোনও উপসর্গ থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে।
চিকিৎসা
আলট্রাসোনোগ্রাফি করাতে বলা হয় রোগীকে। পরীক্ষা থেকে বেশ কতকগুলি বিষয় বোঝা যায়—
i.গোটা থাইরয়েড গ্ল্যান্ডটি ফুলেছে নাকি সেখানে কোনও টিউমার বা নডিউল তৈরি হয়েছে।
ii.টিউমারের মধ্যে কোনও রক্তবাহী নালীর আকার বেড়ে গেলেও তা ধরা পড়ে।
iii.টিউমারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্যালশিয়ামের কণা জমা হলে তাও বোঝা যায়।
iv.যে টিউমারটি থাইরয়েডের উপরে তৈরি হয়েছে তার ধরন কেমন? অর্থাৎ তা কি তরলে পূর্ণ? নাকি তা কঠিন? কিংবা মিলিয়ে মিশিয়ে?
চিকিৎসার পরবর্তী ধাপ
আলট্রাসাউন্ডে থাইরয়েডের চরিত্র দেখে সন্দেহ হলে দুটো কাজ করা যায়। ১) এফএনএসি। ২) ফ্রোজেন বায়োপ্সি (frozen biopsy)।
এফএনএসি বনাম ফ্রোজেন বায়োপ্সি
এফএনএসি-এর পুরো কথাটির অর্থ হল ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি (fine needle aspiration cytology)। এক্ষেত্রে রেডিওলজিস্ট আলট্রাসাউন্ড টেস্ট করানোর সময় থাইরয়েডের যে অংশে সবচাইতে বেশি সমস্যা আছে বলে মনে হচ্ছে সেখান থেকে সুচ ফুটিয়ে কিছু কোষ বা নমুনা সংগ্রহ করেন। প্যাথোলজিস্ট ওই কোষগুলিকে পরীক্ষা করে দেখে বলেন ওই কোষ বিনাইন প্রকৃতির নাকি ম্যালিগনেন্ট? বিনাইন টিউমার ধীরে ধীরে বাড়ে এবং ছড়িয়ে পড়ে না। অর্থাৎ ক্যান্সার নয়। ম্যালিগমেন্ট টিউমার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ক্যান্সার। মুশকিল হল ম্যালিগনেন্ট ক্যান্সারের একাধিক ধরন রয়েছে। থাইরয়েডে প্যাপিলারি ক্যান্সার হতে পারে। এছাড়া হতে পারে ফলিকিউলার টিউমার, অ্যানাপ্লাস্টিক ক্যান্সার, মেডুলারি থাইরয়েড ক্যান্সার ইত্যাদি।
এফএনএসি-এর সীমাবদ্ধতা
টিউমার বিনাইন প্রকৃতির তাহলে কয়েকমাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়। কিছু মাস অন্তর রোগীকে পরীক্ষা করে দেখা হয়। তবে ম্যালিগনেন্ট হলে সমগ্র থাইরয়েডটিই সার্জারি করে বের করে দেওয়া হয়। মুশকিল হল ফলিকিউলার টিউমারের সেল ম্যালিগনেন্ট হতে পারে আবার বিনাইনও হতে পারে। সেক্ষেত্রে শুধু এফএনএসি করে টিউমার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা মেলে না। এই জন্যই এফএনএসি-এর তুলনায় বায়োপ্সি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ বায়োপ্সি করালে টিউমারের কোষগুলো যেমন দেখা যায় তেমনই কোষের সজ্জা সম্পর্কেও ধারণা করা যায়। স্পষ্টভাবে বোঝা যায় রোগীর ক্যান্সার হয়েছে কি না। এই জন্যই থাইরয়েডে টিউমার হলে সরাসরি ফ্রোজেন বায়োপ্সি করা অনেক বেশি উপযোগী।
ফ্রোজেন বায়োপ্সি
এক্ষেত্রে রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে অজ্ঞান করে থাইরয়েডের টিউমার যুক্ত অংশ বের করে নিয়ে বায়োপ্সি করতে পাঠানো হয়। রোগী অজ্ঞান অবস্থাতেই থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বায়োপ্সি করে জানানো হয় টিউমারটি ম্যালিগনেন্ট নাকি বিনাইন। ম্যালিগনেন্ট হলে গোটা থাইরয়েড গ্ল্যান্ডটি তখনই অপারেশন করে বের করে দেওয়া হয়। অপারেশনের পরে রোগীকে রেডিওআয়োডিন থেরাপি দেওয়া হয়। টিউমার বিনাইন হলে রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে কারও কারও বিনাইন টিউমার খুব বড় হয়ে যায়। রোগী সেই টিউমার রাখতে চান না। সেক্ষেত্রেও টিউমার বাদ দেওয়া হতে পারে। এমনকী বিনাইন টিউমার শ্বাসনালীর উপর চাপ সৃষ্টি করলেও সেক্ষেত্রে টিউমার বাদ দিতে হয়। ফ্রোজেন বায়োপ্সির ক্ষেত্রে সুবিধা হল এফএনএসি করার পরে ফের সার্জারি করাতে হয় না। দ্বিতীয়বার অ্যানাস্থেশিয়ার হাত থেকেও রোগী রেহাই পান। এমনকী খরচও অনেক কম হয়।
সার্জারির পরে জীবনযাত্রা
আলাদা করে জীবনশৈলীর কোনও পরিবর্তন করতে হয় না। শুধু থাইরয়েড গ্ল্যান্ড পুরোপুরি বাদ দিতে হলে হরমোন ট্যাবলেট খেতে হয় পরে রোগীকে।