আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথায় অনেকেই কষ্ট পান। এই অসুখ হলে ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি খাওয়াদাওয়া সংক্রান্ত কিছু নিয়ম মেনে চললে ভালো। নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য ও পানীয় এড়িয়ে চলতে পারলে ব্যথার তীব্রতা কমে। সেই সঙ্গে জীবনযাত্রার মানও উন্নত হয়ে উঠতে পারে।
আর্থ্রাইটিস কাকে বলে ?
আর্থ্রাইটিস হল দেহের জয়েন্টগুলিতে (অস্থিসন্ধি) ক্রমিক প্রদাহ। এই অসুখ হলে জয়েন্ট, হাড় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ব্যথা ও ক্ষয় হয়। ব্যথা ও ক্ষয় কোন অঙ্গে হবে ও সেগুলির তীব্রতা আর্থ্রাইটিসের ধরণের ওপর নির্ভর করে।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা হাড়ের গাঁটে গাঁটে বাত হলে প্রদাহ সৃষ্টি হয় না। এটি আর্থ্রাইটিসের সবচেয়ে পরিচিত টাইপ। আর্থ্রাইটিসের একশোটিরও বেশি টাইপ রয়েছে। বিজ্ঞান বলছে, পুরুষদের প্রায় চল্লিশ শতাংশ এবং মেয়েদের প্রায় সাতচল্লিশ শতাংশ এই অসুখে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস (RA) এবং সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস হলে প্রদাহ হয় এবং এগুলোকে Autoimmune disease বলে। গাউট হচ্ছে প্রদাহ সৃষ্টকারী আরেক টাইপের আর্থ্রাইটিস। শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ত্রুটির ফলে এই ব্যবস্থা যখন কোনও অঙ্গের সুস্থ কোষ ও কলাগুলিকে আক্রমণ করে তার ফলে autoimmune disease হয়।
আর্থ্রাইটিস থাকলে যে সব খাবার খাওয়া বারণ সেগুলি হল :-
১. এমনিতেই চিনি শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। তার ওপর আর্থ্রাইটিস থাকলে অতিরিক্ত চিনি দেওয়া খাবার একদমই চলবে না। লজেন্স, সোডা, আইসক্রিম এবং বারবিকিউ সস সমেত অনেক খাবারেই অতিরিক্ত চিনি থাকে। ২০১৭ সালের একটি সমীক্ষা বলছে, চিনি যুক্ত সোডা এবং প্রচুর মিষ্টি দেওয়া সুখাদ্য যেগুলিকে ডেজার্টস বলা হয়, সে সব খেয়ে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের উপসর্গ তীব্রতর হয়ে ওঠে। যাঁরা চিনিসমেত সোডা খান তেমন প্রায় দু’ লাখ মহিলাকে পর্যবেক্ষণে রেখে দেখা গেছে তাঁদের রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
২. একাধিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে রেড মিট (লাল মাংস বা গরু, ভেড়া, ছাগলের মাংস) এবং প্রসেসড মিট (প্রক্রিয়াজাত মাংস) খেলে আর্থ্রাইটিসের লক্ষণগুলি আরো তীব্র হয়ে ওঠে। এবার দেখা যাক এই যোগসূত্রটা কি রকম। রেড মিট ও প্রসেসড মিটে প্রদাহ সৃষ্টিকারী উপাদান ইন্টারলিউকিন-৬(IL-6), সি- রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন(CRP) এবং হোমোসিস্টেইন বেশি থাকায় এমনটা হয়। আর্থ্রাইটিসে ফসফরাসযুক্ত খাবার এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। লাল মাংসে ফসফরাস বেশি থাকে যার ফলে শরীরে অতিরিক্ত ফসফরাস জমা হয় এবং ক্যালসিয়াম কমে যায়। ২০১৭ সালে RA তে আক্রান্তদের মধ্যে একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে যে রেড মিট (গরু, ভেড়া ও ছাগলের মাংস) বেশিরভাগ রোগীর ব্যথা সহ সমস্ত উপসর্গকে আরো কষ্টদায়ক করে তুলছে। একই সঙ্গে প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, দীর্ঘ সময় যাদের দৈনিক খাদ্যতালিকায় রেড মিট রয়েছে তাঁদের আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অন্য দিকে রেড ও প্রসেসড মিট বর্জিত শাকসব্জি সহ ডায়েট আর্থ্রাইটিসের ব্যথা ও অন্যান্য লক্ষণগুলিকে অনেকটা প্রশমিত করে, তাও প্রমাণিত।
৩. যে সব খাবারে গ্লুটেন থাকে সেগুলি এড়িয়ে চলতে হবে। গম, যব, বার্লি ও ট্রিটিকেলে গ্লুটেন (এক ধরণের প্রোটিন) থাকে। সুতরাং আর্থ্রাইটিস রোগীদের গম, যব ও বার্লি থেকে তৈরি আটা ও ময়দায় প্রস্তুত খাবার না খাওয়াই ভালো। গবেষণা জানাচ্ছে যে শরীরে বেশি মাত্রায় গ্লুটেন ঢুকলে আর্থ্রাইটিসের ব্যথা পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে। ডায়েট থেকে গ্লুটেন একদম বাদ দিতে পারলে আর্থ্রাইটিসের কষ্টও কমে। তবে শুধু গ্লুটেন বর্জিত ডায়েট থেকেই বাতের ব্যথা কমে কিনা সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য আরো গবেষণার দরকার।
৪. অতি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বা ultra-processed food items আর্থ্রাইটিস বাড়িয়ে দেয়। পিৎজা, হামবার্গার, হট ডগ প্রভৃতি ফাস্ট ফুড, সকালবেলার প্রাতরাশের ব্রেকফাস্ট সেরেয়াল এবং ভাপানো খাবারদাবারে মিহি (Refined) শস্যদানা, বাড়তি চিনি, প্রিজারভেটিভ সহ এমন অনেক উপাদান থাকে যেগুলি প্রদাহ সৃষ্টি করে। এসবই আর্থাইটিসের জন্য ক্ষতিকর। সাধারণত পশ্চিমি দুনিয়ার মানুষের ডায়েটে প্রসেসড ফুড বেশি থাকায় তাঁদের রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। তার কারণ প্রসেসড ফুড প্রদাহ বাড়িয়ে দেয় এবং ওজন বাড়ায়। রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিসের রোগীদের নিয়ে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করে দেখা গেছে তাঁদের মধ্যে যাঁরা ultra-processed food বেশি খাচ্ছেন তাঁদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার বেশি ঝুঁকি। এ জাতীয় খাবার বেশি খেলে শরীরে গ্লাইসেটেড হেমোগ্লোবিন-এর(HbA1c) মাত্রা বেড়ে যায় যা রক্তে শর্করা বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি।
৫.মদ্যপান আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বাড়িয়ে দেয়। কারো আর্থ্রাইটিস হয়ে থাকলে মদ্যপান একেবারে কমিয়ে দেওয়া উচিৎ। Axial spondyloarthritis প্রদাহ সৃষ্টকারী এক ধরণের আর্থ্রাইটিস যা মেরুদন্ড এবং সাকরোইলিয়াক (SI) সন্ধিতে হামলা চালায়। এই সমস্যায় ভুগছেন এমন রোগীদের পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে মদ্যপান মেরুদন্ডের কাঠামোতে ক্ষয় ধরায়। এ ছাড়া মদ্যপান করলে গাউট তীব্র হয়ে ওঠে। ক্রমাগত মদ্যপান অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ব্যথাও বাড়িয়ে দেয়।
৬. নির্দিষ্ট কয়েকটি উদ্ভিজ্জ তেল অস্টিওআর্থ্রাইটিস এবং রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বাড়িয়ে দেয়। উদ্ভিজ্জ তেলের মধ্যে ওমেগা-৬ ফ্যাট বেশি থাকে, ওমেগা-৩ ফ্যাট কম থাকে যেগুলি বাতের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। অন্য দিকে, এই দুধরণের ফ্যাট স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু বিশেষ করে ইউরোপ, অ্যামেরিকার দেশগুলিতে দৈনিক ডায়েটে ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩ এর অনুপাত সুষম না হওয়ায় আর্থ্রাইটিসের কষ্ট বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন উদ্ভিজ্জ তেলে ওমেগা-৬ জাতীয় চর্বি বেশি থাকে তাই এমন তেল খাদ্যতালিকায় বেশি না রাখাই ভালো। অন্য দিকে চর্বিযুক্ত মাছে ওমেগা-৩ চর্বি বেশি থাকায় এ জাতীয় মাছ বেশি খেলে আর্থ্রাইটিসের ব্যথা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৭. আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন অথচ খাবার পাতে কাঁচা নুন বেশি থাকছে, তা যেন না হয়। নুন খাওয়া কমালে আর্থ্রাইটিসের ব্যথাও কমে যায়। চিংড়ি, ক্যানবন্দী সুপ, পিৎজা, কয়েক ধরণের চিজ এবং প্রক্রিয়াজাত মাংসতে এবং আরো অনেক প্রক্রিয়াজাত খাবারে বেশি নুন থাকে। এসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। নুনের সঙ্গে আর্থ্রাইটিসের সম্পর্ক নিয়ে জানতে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়েছিল। বেশ কিছু দিন কয়েকটি ইুঁদুরকে রোজ বেশি নুনসমেত খাবার এবং কয়েকটি ইঁদুরকে স্বাভাবিক পরিমাণ নুন সমেত খাবার দেওয়ার পর দেখা যায়- যে সব ইুঁদুরকে বেশি নুন খাওয়ানো হয়েছে সেগুলির ভেতরে আর্থ্রাইটিসের লক্ষণগুলি তীব্র হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে যে সব ইুঁদুরকে স্বাভাবিক মাত্রায় নুন খাওয়ানো হয়েছিল তাদের আর্থ্রাইটিসের লক্ষণগুলি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ৬২ দিন ধরে বেশ কয়েকটি ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, যে দলটিকে স্বাভাবিক মাত্রায় নুন খাওয়ানো হয়েছিল তাদের রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা কম। যে দলটিকে বেশি নুন দেওয়া হয়েছিল তাদের এই আশঙ্কা বেশি। সেই সঙ্গে, যে সব ইঁদুর কম নুন খাচ্ছিল তাদের কার্টিলেজে বিশেষ ক্ষয় ধরেনি, সামগ্রিকভাবে হাড়ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েনি। যে সব ইঁদুর বেশি নুন খাচ্ছিল তাদের ক্ষেত্রে বিপরীত ছবি দেখা যায় ।
৮.অ্যাডভান্সড গ্লাইসেশন এন্ড প্রোডাক্টস বা Advanced glycation end products(AGEs) সম্পর্কে সাবধান। চিনি ও প্রোটিন বা ফ্যাটের বিক্রিয়ায় এজিই তৈরি হয়। সাধারণত কাঁচা মাছ মাংসে এজিই থাকে এবং নির্দিষ্ট কিছু রান্নার পদ্ধতির জেরে এজিই উৎপন্ন হয়। হাই প্রোটিন এবং হাই ফ্যাট সমেত প্রাণীজ খাদ্য ভাজা, পোড়ানো, ঝলসানো বা স্যাঁকা হলে সেগুলো এজিই-এর বিরাট ভান্ডার হয়ে ওঠে। বেকন, প্যানে ভাজা বা গ্রিল করা স্টেক, রোস্ট বা ভাজা মুরগি এবং ব্রয়েল করা মাংস এবং হট ডগ-এর ভেতরে এজিই থাকে। এছাড়া আলু ভাজা, আমেরিকান চিজ, মার্জারিন এবং মেয়োনিজেও থাকে এজিই। শরীরে অতিরিক্ত এজিই জমে গেলে Oxidative stress এবং প্রদাহ হতে পারে যা আর্থ্রাইটিসের প্রকোপ বাড়িয়ে দিতে পারে। যে সব রোগী আর্থ্রাইটিসে খুব বেশি কষ্ট পান তাঁদের অনেকের দেহেই অতিরিক্ত এজিইস জমতে দেখা গেছে। যাদের আর্থ্রাইটিস নেই তাদের দেহে অতিরিক্ত এজিইস থাকে না। এছাড়া হাড় ও অস্থিসন্ধিগুলিতে এজিই জমা হলে অস্টিওআর্থ্রাইটিস তাড়াতাড়ি শুরু হয়, দ্রুত ছড়িয়েও পড়ে।এজিইর বদলে সব্জি, ফল, মাছ, শিম বেশি করে খাওয়া যেতে পারে।
টম্যাটো খাবেন না। টম্যাটোতে ইউরিক অ্যাসিড থাকে। এই অ্যাসিড হাড়ের জোড় বা জয়েন্টে জমা হয়, যা আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বাড়ায়। এ ছাড়া বেগুন, পাকা লঙ্কা, আলু এগুলোর মধ্যে অ্যালকালোয়েডস আছে। এগুলো প্রদাহ তৈরি করে। তাই হাড়ের জোড়ে ব্যথা থাকলে এগুলো খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিন। সীমিত পরিমাণে কফি পান করা উচিৎ। কফি শরীরে জলের পরিমাণ কমিয়ে দেয় যার ফলে আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বেড়ে যায়।
এখানে একটা ব্যাপার অবধারিতভাবে মনে রাখতে হবে। কোনও রোগীর লাইফস্টাইলের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি বিষয়ের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখলে আর্থ্রাইটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই বিষয়গুলি হল- আর্থ্রাইটিস অথবা বাতের ব্যথায় কষ্টে পাওয়া ব্যক্তি কতটা শারীরিক কসরত করেন, ব্যক্তির ওজন এবং তিনি ধূমপান করেন কিনা, করলে কত বেশি করেন। সেই সঙ্গে
আর্থ্রাইটিসের কষ্ট দূর করার জন্য নিজেই নিজের চিকিৎসা না করে বা বাজারে চালু তেলের সাহায্য না নিয়ে অবিলম্বে অস্থিবিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।