এ ডি এইচ ডি কি ? ADHD কথাটির পুরো অর্থ হল Attention deficit hyperactivity disorder, এটি একটি neurodevelopmental disorder যা শিশুদের মধ্যে প্রচুর দেখা যায় এবং বড় হওয়ার পরও এটা থেকে যায় অনেক সময়। যেসব শিশুরা ADHD তে ভোগে তাদের কোনো কোনোকিছুতে মনোযোগ করতে সমস্যা হয়, ইম্পালসিভ বিহেভিয়ার কে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না (সেই কাজের কি ফল হবে তা না ভেবেই কাজটা করে ফেলে), অথবা অতিরিক্ত পরিমানে সক্রিয় হয়ে যায়।
যেসব শিশুরা ADHD তে ভোগে তাদের ভেতর নিম্ন আত্মমর্যাদা, বিভিন্ন সম্পর্কে সমস্যা এবং বিদ্যালয়ে বিভিন্ন পারফরম্যান্সে সমস্যা দেখা যায়। এইসব লক্ষন বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে, তবে কারোর কারোর ক্ষেত্রে বড় বয়সেও এই সমস্যাগুলো থেকে যায় এবং কখনই পুরোপুরি সারে না। তবে বিভিন্ন পদ্ধতির দ্বারা এই সব সমস্যার সমাধান করা এদের শেখানো হয়।
চিকিৎসার মাধ্যমে ADHD কে সারানো যায় না, তবে লক্ষনগুলো কম রাখতে ভীষণ সাহায্য করে। ওষুধ ও ব্যবহারিক পরিবর্তন হল চিকিৎসার অঙ্গ। প্রথম থেকে চিকিৎসা শুরু হলে খুব ভালো ফলাফল দেখা যায়।
এ ডি এইচ ডি রোগের লক্ষন কি ?
এই রোগ সাধারণত ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের ভেতর দেখা যায়, ৩ বছরের ছোট শিশুদের মধ্যেও দেখা গেছে। শিশুকাল থেকে শুরু হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও অনেকসময় রোগলক্ষন থেকে যায়। মেয়েদের থেকে ছেলেদের মধ্যেই ADHD বেশি দেখা যায় এবং তাদের মধ্যে রোগলক্ষনেরও পার্থক্য থাকে; যেমন ছেলেরা অতিরিক্ত চঞ্চল হয়ে থাকে, আবার মেয়েরা অতিরিক্ত অমনোযোগী হয়ে থাকে।
ADHD এর আবার তিনটি প্রকার আছে —
- প্রধানত অমনোযোগী – সব বিষয়ে অমনোযোগই প্রধান রোগলক্ষন হিসাবে দেখা যায়।
- প্রধানত অতিসক্রিয়তা/ অতি আবেগপ্রবণতা – এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজে অতিসক্রিয়তা এবং অতি আবেগপ্রবণতা প্রধান রোগলক্ষন হিসাবে দেখা যায়।
- মিশ্রিত রোগলক্ষন – এই ক্ষেত্রে অমনোযোগী এবং অতিসক্রিয়তা উভয় লক্ষনই পরিলক্ষিত হয়।
অমনোযোগী :
যে শিশুদের মধ্যে এই অমনোযোগীতার লক্ষন দেখা, তারা প্রায়ই
- কোনো বিষয়ে গভীর মনযোগ দিতে সক্ষম হয় না
- স্কুলের নানা কাজে অসাবধানতার জন্য ভুল করতে থাকে
- কোনো কাজ বা খেলাধূলাতে অধিক সময় ধরে মনযোগে অক্ষম হয়
- সামনা-সামনি কথা বললেও তা সম্পূর্ণ শুনে উঠতে না পারা
- নির্দেশ শুনে কোনো কাজ না করে উঠতে পারা এবং বিদ্যালয়ে বিভিন্ন কাজ না করতে পারা
- বিভিন্ন কাজকে গুছিয়ে করতে না পারা
- যেসব কাজে গভীর মনযোগ দরকার পরে তা অপছন্দ করা বা এড়িয়ে চলা
- খেলনা, পেন্সিল, বই–খাতা ইত্যাদি প্রায়ই হারিয়ে ফেলা
- খুব সহজেই মনযোগ সরে যাওয়া
- রোজকার কাজ করতে ভুলে যাওয়া
অতিসক্রিয়তা ও অতি আবেগপ্রবণতা :
যাদের মধ্যে এই লক্ষনগুলি দেখা যায়, তারা প্রধানত—
- অকারণে হাত–পা নাড়াতে থাকে
- এক জায়গায় শান্ত ভাবে বসতে পারে না
- সব সময় কিছু না কিছু করে নানা অঙ্গ ভঙ্গি করে যেতে থাকে
- যে কোনো জায়গায় লাফাতে বা দৌড়াতে শুরু করে দেয়
- শান্ত ভাবে কোনো কাজ বা যে খেলাধূলায় শান্ত থাকার প্রয়োজন হয় তা করতে পারে না
- অতিরিক্ত কথা বলে
- কোনো খেলাধূলায় নিজের সুযোগ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না
ADHD এর কারণ কি ?
ADHD এর সঠিক কারন যদিও এখনও জানা যায় না তবে দেখা গেছে বংশগতি, সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের সমস্যা, পরিবেশ দূষণের ফলে তৈরি বিষাক্ত পদার্থের (যেমন সিসা) সংস্পর্শে আসা, গর্ভাবস্থায় মায়ের ব্যবহৃত ওষুধ, গর্ভাবস্থায় মায়ের ধূমপান, মদ্যপান, প্রিম্যাচিওর বেবির ক্ষেত্রে ADHD তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় যেমন মা – বাবা, বা দাদা দিদির ভেতর ADHD অথবা অন্য মানসিক সমস্যা থাকলেও ADHD তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
ADHD আক্রান্ত শিশুদের কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়?
- ক্লাসরুমে মানিয়ে নিতে সমস্যা, ফলে বেশিরভাগ সময়ই ফলাফল খারাপ হয়
- অন্যান্য বাচ্চাদের থেকে বেশি আঘাত ও দুর্ঘটনার শিকার হওয়া
- অত্যন্ত কম আত্মবিশ্বাস
- কথাবার্তা বলায় সমস্যা হওয়ার কারণে বন্ধুদের সাথে সহজে মিশতে পারে না।
ADHD আক্রান্ত শিশুদের একইসাথে আরও কিছু সমস্যা দেখা যায়, সেগুল হল—
- Oppositional Defiant Disorder : অথতিটি ফিগার বা কোনো সংস্থা বা গৃহের প্রধানের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব এবং ব্যবহার তৈরি হয়।
- Conduct Disorder : অপরাধ প্রবনতা, সমাজবিরোধী জাতীয় কার্যকলাপ করে থাকে, যেমন চুরি করা, অকারণ মারপিট করা, মানুষ বা পশুকে আহত করা ইত্যাদি।
- Disruptive Mood Dysregulation Disorder : অতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে পড়া এবং হতাশা কে সহ্য করতে না পারা
- Learning Disability : পড়তে, বলতে, লিখতে সমস্যা হওয়া
- Substance Use Disorder : মাদক, ড্রাগ ইত্যাদির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়া
- Anxiety Disorder : অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে যাওয়া, দুশ্চিন্তা করা এবং অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD)
- Mood Disorder : হতাশা এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডার
- Autism Spectrum Disorder : মস্তিষ্কের বিকাশ কেমন ঘটছে তা দেখা হয় বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতির সাথে কেমন ভাবে মানিয়ে নিচ্ছে তা দেখে বোঝা যায়।
- Tic Disorder / Tourette Syndrome : অকারণ মুখে নানা রকম আওয়াজ করা এবং কথা বলার সময় অপ্রয়োজনীয় ভাবে হাত পা সঞ্চালন করা।
কিভাবে এ ডি এইচ ডি প্রতিরোধ করা সম্ভব ?
শিশুদের মধ্যে ADHD কে নিয়ন্ত্রন করতে কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে —
- প্রসবকালীন সময়ে এমন সব কিছুকে এড়িয়ে যেতে হবে যা ভ্রূণের ক্ষতি করে। মদ্যপান, ধূমপান এবং প্রেগন্যান্সিতে বিপজ্জনক এমন সব ওষুধকে বর্জন করতে হবে।
- শিশুকে সব বিষাক্ত পদার্থ ও দূষণ থেকে দূরে রাখতে হবে। সিগারেটের ধোঁয়া এবং রঙের বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে শিশুকে রক্ষা করতে হবে।
- স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করা, যদিও সম্পূর্ণ ভাবে প্রমানিত নয়, তবে শিশুদের বিশেষ করে জীবনের প্রথম পাঁচ বছরে টিভি দেখা এবং ভিডিও গেম খেলা থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে।
এ ডি এইচ ডি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
সাধারণত শিশুদের মধ্যে ১২ বছরের আগেই যদি ADHD এর জন্য গুরুতর সমস্যা দেখা যায় এবং স্কুলে ও পড়াশোনায় ক্ষতি করে তাহলে শিঘ্র রোগ নির্ণয় করা ও চিকিৎসা করার প্রয়োজন হয়। অনেক সময় খুব ছোটো বাচ্চাদের ভেতর ADHD এর মতো রোগলক্ষন দেখা যায়, কিন্তু সেগুলো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার হয়ে থাকে, যেমন দেরীতে কথা বলা, পরিস্কার ভাবে কথা বলতে না পারা ইত্যাদি। তাই প্রিস্কুলের বাচ্চাদের ভেতর এই জাতীয় রোগ লক্ষন দেখা দিলে তা নির্নয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট, স্পিচ প্যাথোলজিস্ট বা ডেভেলপমেন্টাল পেডিয়াট্রিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন।
শিশুদের মধ্যে ADHD এর চিকিৎসার জন্য যে যে পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করা হয়, সেগুলি হল—
ওষুধ, বিহেভিয়ার থেরাপি, কাউন্সেলিং, এডুকেশন থেরাপি
স্টিমুল্যান্ট মেডিকেশন : বর্তমানে এই ধরনের সাইকোস্টিমুল্যান্ট ওষুধ বিশেষ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এইসব ওষুধের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারকে নিয়ন্ত্রণ করা ও উদ্দীপিত করা হয়। এর ফলে রোগলক্ষন কম থাকে এবং তা অনেক সময়ে খুব অল্প সময়ের ভেতরই ফলাফল দিতে শুরু করে।
স্টিমুল্যান্ট মেডিকেশনের যে যে খারাপ প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়—
- হার্ট প্রবলেম
- সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম
- শিশুদের ও টিনএজারদের ADHD এর ওষুধের দায়িত্ব কোনো অভিভাবককে নিতে হবে। তাদের হাতে ওষুধের দায়িত্ব দেওয়া যাবে না।
- ওষুধের সংগ্রহকে শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
- শিশুদের সাথে ADHD এর ওষুধ কখোনই স্কুলে পাঠানো যাবে না।
ADHD বিহেভিয়ার থেরাপি
- অভিভাবক ও শিক্ষক – শিক্ষিকাদের বিহেভিয়ার থেরাপি শিখতে হবে, যেমন টোকেন সিস্টেম ও টাইম আউট পদ্ধতি, কঠিন সময়কে সামলানোর জন্য।
- সোশাল স্কিল ট্রেনিং এর মাধ্যমে শিশুরা সঠিক সামাজিক ব্যবহার কিরতে শেখে
- প্যারেন্টিং স্কিল ট্রেনিং এর মাধ্যমে মা-বাবারা শিশুর সমস্যা বুঝতে এবং তাকে সঠিক ভাবে গাইড করতে সক্ষম হয়।
- সাইকোথেরাপি, এর মাধ্যমে একটু বড় বয়সের বাচ্চারা নিজেদের সমস্যার কিথা নিজেরা খুলে বলতে পারে। কোন কোন বিষয় তাদের বেশি অসুবিধায় ফেলে তা তারা নিজেরা বলতে পারে।
- ফেমিলি থেরাপি, এর মাধ্যমে পরিবারে কোনো শিশু ADHD তে আক্রান্ত থাকলে, তার সাথে কিভাবে ব্যবহার কিরতে হবে, তা অভিভাবক ও অন্য ভাই বোনদের শেখানো হয়।
নতুন মেডিক্যাল ডিভাইস
৭–১২ বছরের বাচ্চারা যারা ADHD এর অন্য কোনো ওষুধ নিচ্ছে না তাদের জন্য U.S Food and Drug Administration শুধুমাত্র প্রেস্ক্রিপশনের ভিত্তিতে একটি ডিভাইস কে মান্যতা দিয়েছেন যেটা Monarch External Trigeminal Nerve Stimulation (eTNS) System নামে পরিচিত। একটি সেল ফোনের আকারের এটি এবং অবশ্যই অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে ব্যবহার করতে হয়, যখন শিশু ঘুমিয়ে থাকে, তখন তার কপালে রাখতে হয়। এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের যে অংশ থেকে ব্যবহার, আবেগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয়, সেখানে একটা খুব কম লেভেলে ইলেক্ট্রিক স্টিমুলেসজন পাঠানো হয়।
জীবন যাত্রার পরিবর্তন
- শিশুকে যথেষ্ট পরিমানে ভালোবাসা, যত্ন, উৎসাহ ও গুরুত্ব দিতে হবে।
- শিশুর যাতে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায়, সেদিকে নিজর দিতে হবে
- শিশুকে সমস্যায় ফেলে এমন পরিস্থিতি থেকে তাকে দূরে রাখা
- রোজের খাওয়া ঘুমের নির্দিষ্ট সময় কিরে দেওয়া
- সামাজিক মেলামেশায় উৎসাহ প্রদান
- স্কুলের অনুষ্ঠান ও ক্লাসের ব্যাপারে গল্প করা
- শিশুর শিক্ষক – শিক্ষিকার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা