বিশেষ প্রতিবেদন (কলকাতা): হলিউড হিরোইন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি আর মেদিনীপুর নিবাসী বছর সাঁইত্রিশের গৃহবধূ মৌসুমি রায়ের মধ্যে মিল কোথায় হতে পারে ?
- সচেতনতায়… সাহসে … ক্যান্সারের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপে এবং মাতৃবিয়োগের স্মৃতিতে।
বছরের শুরুতেই একেবারে প্রথম পর্যায় মৌসুমির স্তনে ক্যান্সারাস টিউমার ধরা পড়ল। অ্যাপেলো হাসপাতালের অঙ্কোলজি বিভাগের শল্যচিকিৎসক ডাঃ শুভদীপ চক্রবর্তীর সিদ্ধান্তে টিউমারটিকে অস্ত্রপচার করে বাদ দেওয়া হয়। সুস্থ হয়ে ওঠেন মৌসুমি। পরিবারের শিয়রে থাকা আশঙ্কার মেঘ কাটে। তবে ঘটনার শেষ এখানেই নয়। কারণ তা হলে আজ ক্যান্সার সচেতনতায় উদাহরণ হয়ে উঠতেন না মৌসুমি রায়।
অস্ত্রপচার করে বাদ দেওয়া অংশটির BRCA ( Breast Cancer Gene Test ) করাতে চান মৌসুমি। তিনি জানতেন বিআরসিএ পরীক্ষায় ক্যান্সারের ভবিষ্যৎ সম্ভবনা ধরা পরে। এপ্রিলে রিপোর্ট আসে পজিটিভ, অর্থাৎ আগামীতে মৌসুমির জন্য দাঁত-নখ বার করে অপেক্ষা করছে কর্কট দানব। ভবিষ্যতে স্তন এবং জরায়ুতে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। ভয় পায়নি মৌসুমি, তাঁর অতীত অভিজ্ঞতাই তাঁকে লড়াই করার সাহস দিল।
বছর সাতেক আগে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি বেভারলি হিল হসপিটালে যা করিয়ে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে সংবাদ শিরোনামে এসেছিলেন, কলকাতার অ্যাপেলো হাসপাতালে তাই করালেন মৌসুমি। অস্ত্রপচারের মাধ্যমে ক্যান্সারের আগাম সম্ভবনা নির্মূলীকরণ। নিপিল স্পারিং ম্যাস্টেক্টমি, এই অস্ত্রপচারে স্তনবৃন্তকে অক্ষত রেখে স্তনের অভ্যন্তরীন পেশীগুলিকে বাদ দেওয়া হয় এবং আক্রান্তের শরীরের অন্যত্র অংশ থেকে পেশী নিয়ে স্তনকে আবার পুণর্গঠন ও পুণর্স্থাপন করা হয়।
“অ্যাঞ্জেলিনা জোলির এই সিদ্ধান্তের কথা জানতাম, কিন্তু ভারতে তা সম্ভব কিনা তা জানা ছিল না। যদিও মানসিক ভাবে তা মনে প্রাণে চাইছিলাম। আমার স্বামীর সমর্থন আমাকে জোর দিচ্ছিল। যখন চিকিৎসক জানালেন যে কলকাতার অ্যাপেলো হাসপাতালে এই ধরণের অস্ত্রপচার সম্ভব তখন অবাক তো হয়েইছিলাম সাথে খুশিও হয়েছিলাম” – জানালেন মৌসুমি রায়।
স্তনের সাথে ল্যাপ্রোস্কোপিক বাইল্যাটারাল স্যালফিঙ্গো-ওফেরেক্টোমি করে মৌসুমির দুটি ডিম্বাশয় এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবও বাদ দেওয়া হয়। “বিআরসিএ রিপোর্ট অনুযায়ী স্তন ক্যান্সারের সম্ভবনা ছিল ৯০%। অস্ত্রোপচারের পর তা ৫% ও নিচে নেমে এসেছে, যা মৌসুমির বয়সী সাধারণ ভারতীয় নারীদের গড় সম্ভবনার থেকেও কম।” – বললেন অ্যাপেলো হাসপাতালের অঙ্কোলজি বিভাগের শল্যচিকিৎসক ডাঃ শুভদীপ চক্রবর্তী।
ডাঃ শুভদীপ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সমস্ত অস্ত্রোপচার করতে সময় লেগেছে আট ঘন্টা। ডাঃ চক্রবর্তীর সাথে ছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞা ডাঃ রমা ব্যানার্জী, প্লাস্টিক সার্জেন ডাঃ সপ্তর্ষি ব্যানার্জী, সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট ডাঃ তাপস কর সহ বেশ কিছু বিশিষ্ট চিকিৎসক। অ্যাপেলো হাসপাতালের অঙ্কোলজি বিভাগের সার্জিক্যাল অঙ্কোলজির ডিরেক্টার, ক্যান্সার সার্জেন সৈকত গুপ্ত জানান – “ এই ধরণের বিশেষ এবং ব্যতিক্রমী ঘটনার অস্ত্রোপচার এবং তার পরবর্তী অবস্থার চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয়ের জন্য আমাদের একটা মেডিক্যাল বোর্ড তৈরী হয়েছিল যাতে ম্যেডিক্যাল, সার্জিক্যাল এবং রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্টরা ছিলেন। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় এবং মৌসুমি দেবী ও তাঁর পরিবারের সহযোগীতায় এই জটিল অস্ত্রোপচার সম্ভব হয়েছে।”
অ্যাপেলো হাসপাতালের মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিরেক্টর ডাঃ শ্যামাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন – “ যে সকল নারীদের এধরণের ভয়াবহ ক্যান্সারের সম্ভবনা রয়েছে তাঁদের জন্য মৌসুমি এক প্রেরণা এবং উদাহরণ।”
অ্যাপেলো হাসপাতালের পূর্বাঞ্চলের সিইও রাণা দাসগুপ্ত সমস্ত মেডিক্যাল টিমকে এবং মৌসুমি রায়কে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন যে – “ আমাদের উপর ভরসা রাখার জন্য মৌসুমি দেবী ও তাঁর পরিবারকে ধন্যবাদ।” পুর্ব-ভারতে প্রথমবার নিপিল স্পারিং ম্যাস্টেক্টমি দ্বারা স্তনবৃন্তকে অক্ষত রেখে স্তনের অভ্যন্তরীন পেশীগুলিকে বাদ দেওয়া হল এবং আক্রান্তের শরীরের অন্যত্র অংশ থেকে পেশী নিয়ে স্তনকে আবার পুণর্গঠন ও পুণর্স্থাপন করা হল সাথে ল্যাপ্রোস্কোপিক বাইল্যাটারাল স্যালফিঙ্গো-ওফেরেক্টোমি করে মৌসুমির দুটি ডিম্বাশয় এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবও বাদ দেওয়া হল। কার্যত চিকিৎসার ইতিহাসে সম্ভবত কলকাতার আবার নজির রাখল মৌসুমি রায়ের এই সাহসী পদক্ষেপের উপর ভর করে।