একটু সতর্ক হলেই খুব সহজেই স্তন ক্যান্সারের লক্ষণগুলি চিহ্নিত করা সম্ভব অথচ ভারতবর্ষ-বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বেজুড়ে নারী মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ এই স্তন ক্যান্সার বা ব্রেস্ট ক্যান্সার (Breast Cancer)। ভারতে নারী মৃত্যুর জন্য যে ক্যান্সারগুলি সবচেয়ে বেশী দায়ী সেটি হল ব্রেস্ট ক্যান্সার। দেখা গেছে প্রতি ১০০০০০ জন মহিলার প্রায় ২৬ জনই এই ক্যান্সারে আক্রান্ত।
স্তন ক্যান্সারের কারণ
বয়ঃসন্ধির পর থেকেই মেয়েদের স্তন-এর বিকাশ ঘটতে থাকে। অজস্র কলা-কোষ, রক্তজালিকা, গ্রন্থি ও স্নেহ পদার্থ বা ফ্যাট-এর সমন্বয়ে স্তন গঠিত হয়। যখন দেহের কোষগুলী স্বাভাবিক এর তুলনায় দ্রুত ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও মৃত্যু ঘটে না তখন ওই কোষ গুলী টিউমারের আকারে জমতে থাকে এবং ক্যান্সারের সৃষ্টি করে এই অস্বাভাবিক কোষগুলি আশে-পাশের স্বাভাবিক বা সুস্থ কোষগুলি থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, খাদ্য ও অন্যান্য উপাদান গ্রহণ করে । কোষগুলি আক্রান্ত স্তনের জালিকাবাহ বা রক্তবাহের মাধ্যমে দেহের লিম্ফ নোডগুলিতে এবং দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে এই রোগের ভয়াবহতাকে বাড়িয়ে তোলে । স্তনের দুধ উৎপাদনকারি নালীগুলি র কোষগুলির সর্ব প্রথম এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
দেহে হরমোন এর ভারসাম্যহীনতা , আধুনিক জীবনযাত্রা এবং পরিবেশগত সমস্যা স্তন ক্যান্সারের (Breast Cancer) ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
তবে এইসব ঝুঁকির কারণ না থাকলেও কিছু কিছু মানুষের মধ্যে স্তন ক্যান্সার হয়। তার কারণ হল তার জিন । কারও মা বা তার বংশের ব্রেস্ট ক্যান্সার থাকলে ভবিষ্যতে তার স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেড়ে যায় ।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ
- স্তনের ত্বকের নিচে বা বগলে শক্ত পিণ্ডের মত বা ঘন হওয়া যা চারপাশের টিস্যু থেকে আলাদা অনুভুত হয়।
- স্তনের আকার বা আয়তন এর পরিবর্তন ঘটে ।
- স্তনের বৃন্তটি উলটানো বাটির মতন আকার ধারণ করতে থাকে।
- স্তনের ত্বক কমলা বা লালচে বর্ণ ধারণ করতে পারে।
- স্তনবৃন্তের আকার এবং অবস্থানের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
- স্তনবৃন্তের চারপাশে ফুসকুড়ি বা র্যাশ দেখা যায়।
- স্তনের ত্বকর নির্মোচন বা উঠা ।
স্তন ক্যান্সারের রোগ নির্ধারণ
স্তন পরীক্ষা- একজন নিজেই আয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে এই পরীক্ষা করতে পারে। স্তনের উপর হাত বুলিয়ে দেখতে হবে কোনও শক্ত পিণ্ডের মত অনুভুত হচ্ছে কি না এবং স্তনের আকার এবং স্তনবৃন্তের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে কি না ।
ম্যামোগ্রাম– এটি একটি বিশেষ ধরনের এক্স-রে, এর সাহায্যে স্তনের অস্বাভাবিকতা এবং ক্যান্সারের কারণে স্তনে সৃষ্ট লাম্প বা শক্ত মাংসপিণ্ড এর খোঁজ করা হয়।
ইউ.এস.জি ও এম.আর.আই– শিষ্ট বা টিউমারের প্রকৃতি এবং ক্যান্সারের বিস্তার জানতে ব্যবহৃত হয়।
বায়োপসি– এক্ষেত্রে দেহের আক্রান্ত স্থান বা টিউমার থেকে কোষ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। এটির সাহায্যে ক্যান্সারের প্রকৃতি এবং হরমনের সক্রিয়তা নিশ্চিত করা হয়।
এছাড়াও চিকিৎসকরা টিউমারে অবস্থান প্রকৃতি দেখেও এই রোগ নির্ধারণ করতে পারেন।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা
শল্য চিকিৎসা– অস্ত্রোপচার এর মাধ্যমে আক্রান্ত স্তন অপসারণ করা হয়। যাকে মাসটেকটমি (MASTECTOMY) বলা হয়, অনেক সময় কেবল টিউমার এবং চারপাশে টিস্যুগুলি সরিয়ে ফেলা হয় , একে BCS (Breast Conservation Surgery) বলা হয়।
কেমোথেরাপি– শক্তিশালী ওষুধের সাহায্যে দ্রুত বিভাজিত ক্যান্সারের কোষ গুলিকে ধ্বংস করাই কেমোথেরাপির মুল লক্ষ্য। অস্ত্রোপচার এর পর অবশিষ্ট ক্যান্সার এর কোষগুলি অর্থাৎ Circulating Tumor Cell ( CTC ) বিনষ্ট করতে কেমোথেরাপি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই শক্তিশালী ওষুধগুলি যেমন এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে, ঠিক তেমনি বমিভাব, চুল পড়া, এবং ক্লান্তির মতো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে ।
হরমোন থেরাপি– প্রস্টেট এবং ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসায় এটি দেহে হরমোনের উৎপাদনকে বন্ধ করে বা নিয়ন্ত্রণ করে ক্যান্সারের কোষগুলির বৃদ্ধিকে এবং দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়া কে আটকায়।
রেডিয়েশন থেরাপি– এই পদ্ধতির মাধ্যমে উচ্চশক্তি সম্পন্ন তরঙ্গ বা কণিকা ব্যবহার করে অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষগুলি কে ধ্বংস করা হয় । চিকিৎসকরা দেহের আক্রান্ত অংশকে চিহ্নিত করার পর ওই নির্দিষ্ট অংশেই রেডিয়েশন থেরাপি প্রয়োগ করা হয় ফলে Local Recurrence এর প্রবণতা কমে যায় ।
স্তন ক্যান্সার সচেতনতা এবং গবেষণার ফলে স্তন ক্যান্সারের নির্ণয় এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিস্তর অগ্রগতি হয়েছে এবং স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তদের বেঁচে থাকার হার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি এই রোগের সাথে জড়িত মৃত্যুর সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে কমেছে। তবুও দক্ষিণ এশিয়ার উন্নতশীল দেশগুলিতে অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে বহু মহিলার মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে দুরে থাকতে তামাক এবং অ্যালকোহল থেকে নিজেকে বিরত রাখুন, ফাস্টফুড জাতীয় খাবার বর্জন করুন এবং সন্দেহজনক কিছু দেখলে বা অনুভব করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।