শিশুর দেরিতে কথা বলার কারণ ও সমাধান কি এ সম্পর্কে অনেকেই অজ্ঞাত।একটি দু’বছরের বাচ্চা সাধারণত ৫০-৬০ টি শব্দ বলতে পারে, শুধু তাই নয়, দু-তিন শব্দের বাক্যও বলতে পারে তারা। এবং তিন বছর বয়স হলে তাদের বলা শব্দ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় এক হাজারে।
ছোট শিশুদের বেড়ে ওঠার কিছু নির্দিষ্ট পর্যায় থাকে। যেমন, একটি নির্দিষ্ট বয়সে তারা উপুড় হতে শেখে, তারপর বসা শেখে, হামাগুড়ি দেয়া শুরু করে, সেভাবেই একটি নির্দিষ্ট বয়সে তারা কথা বলাও শুরু করে। ঐ বয়সে বা তার কিছু পরে যদি শিশুরা কথা বলা শুরু না করে তাহলে অবশ্যই বাবা-মাকে এই ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
তবে বাচ্চার কথা বলতে দেরি হলে প্রথমেই ভয়ের কিছু নেই। সবসময় এর কারণ গুরুতর নাও হতে পারে৷ তবে কখনও কখনও কানে না শুনতে পাওয়ার জন্য বা অন্য কোনো স্নায়ুঘটিত সমস্যার জন্যও বাচ্চাদের ‘Speech Delay’ হতে পারে।
শিশুদের কথা বলতে দেরি হওয়া বা Speech delay কী?
কথা বলা এবং ভাষার দক্ষতা একটি শিশুর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার অন্যতম লক্ষণ। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মুখের বুলি গুলিই প্রথম একটি বোধগম্য শব্দের জন্ম দেয়।
একটি শিশুর দেরিতে কথা বলার কারণ বোঝা যায় যখন কোনও বাচ্চা তার কথার স্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে না পারে।
একটি তিন বছরের বাচ্চা মোটামুটি এক হাজার শব্দ বলতে পারে৷ তার কাছের মানুষদের তাঁদের নামে ডাকতে পারে৷ তিন-চার শব্দের বাক্য, বাচ্চাদের ছোট ছড়া, এমনকি কয়েক লাইন গানও গাইতে পারে৷ ৫০-৯০% এই বয়সের বাচ্চারা অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতেও পারে।
শিশুদের দেরিতে কথা বলার লক্ষণ
যদি দু’মাস পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো শিশুর মুখ থেকে কোনোরকম আওয়াজ শোনা না যায়, তবে ধরে নিতে হবে এটাই স্পিচ ডিলে-র প্রাথমিক লক্ষণ৷ দেড় বছরের পর থেকে বাচ্চারা সাধারণত বাবা, দাদা, মা ইত্যাদি ডাকতে শিখে যায়, তাই এদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে৷
মোটামুটি ভাবে ২ বছর বয়সে অন্তত ২৫টি শব্দ বলা, আড়াই বছরে আশেপাশে থাকা জিনিসের নাম জানা এবং বলা, এবং তিন বছর বয়সে অন্তত ২০০টি শব্দ বলা এবং সবসময় কাছাকাছি থাকা মানুষদের তাদের নিজের নামে চিনতে না পারলে বুঝতে হবে সেই বাচ্চাটির মধ্যে স্পিচ ডিলে-র সমস্যা আছে৷
শিশুর দেরিতে কথা বলার কারণ কী কী?
শিশুর দেরিতে কথা বলার কারণগুলি নিম্নে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল।
১. মুখের ত্রুটি
অনেকসময় মুখ, জিভ বা টাকরার কোনো ত্রুটির কারণেও বাচ্চাদের কথা বলতে দেরি হয়।
টাং টাই বা অ্যানকাইলোগ্লসিয়াও বাচ্চাদের কথা বলার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অ্যানকাইলোগ্লসিয়া বা টাং টাই একটি জন্মগত ত্রুটি যা জিভের অগ্রভাগের নড়াচড়া কমিয়ে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে লিংগুয়াল ফ্রেনাম অস্বাভাবিক ছোট এবং পুরু হয়। একটি মেমব্রেন জিভের নিচের অংশকে মুখের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখে। অ্যানকাইলোগ্লসিয়া বা টাং টাইয়ের কারণে তাই কথা বলতে সমস্যা হওয়া ছাড়াও খাবার খেতেও সমস্যা দেখা দেয়।
২. কথা বলা এবং ভাষার সমস্যা
একটি শিশু জন্মের পরে কান্না এবং প্রথম তিন মাস ধরে আশপাশের শব্দের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। ছ’মাসের পর থেকে স্বরবর্ণের সঙ্গে ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে কথা বলতে শেখে। যেমন বাবা,মা, দাদা ইত্যাদি। এই সময়ে নিজের নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেওয়ার একটি প্রবণতাও তার মধ্যে তৈরি হয়। দেড় বছরে বয়সে ইশারায় তাদের কথা বোঝাতে পারে। এর পর থেকেই তার আধো বুলি গুলো পরিণত হয় অনর্গল কথায়। তিন বছর বয়সে পৌঁছেও যদি তা সম্ভব না হয়, তবে সম্ভবত সেই শিশুটি স্পিচ ডিলে-র সমস্যায় ভুগছে
কথা বলতে গেলে কোনও বার্তা প্রথমে মুখ থেকে মস্তিষ্কে পৌঁছনো দরকার। মস্তিষ্ক থেকেই বার্তা আসে যে, মুখের পেশী কখন নাড়াচাড়া করতে হবে এবং কী ভাবে কথা বলতে হবে। চাইল্ডহুড অ্যাপ্রেক্সিয়া অব স্পিচ (ক্যাস) জনিত সমস্যা থাকলে শিশুরা সবটা বুঝতে পারে এবং কথা বলতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত সে বলে উঠতে পারেনা৷
৩. সময়ের আগে জন্ম বা Premature Birth
সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করলে, বা জন্মের সময় স্বাভাবিকভাবের তুলনায় ওজন কম থাকলে, কিংবা জন্মের সময় চিকিৎসাগত কোনো ত্রুটি শিশুর দেরিতে কথা বলার কারণ হয়ে উঠতে পারে। গর্ভাবস্থায় ৪০ সপ্তাহ পূর্ণ না হওয়ার অন্তত ৩ সপ্তাহ আগে কোনো শিশু জন্মালে তার মানসিক এবং মস্তিষ্কের বিকাশ সম্পূর্ণ হয় না। ফলে দেখা দেয় স্পিচ ডিলে-র মতো সমস্যা৷
৪. কানে শুনতে না পাওয়া
বাচ্চারা তার চারপাশে যেসব শব্দ শোনে, সেগুলো মনে রেখেই বলার চেষ্টা করে। তাই কোনো শিশু যদি ঠিকমতো শুনতে না পায় বা অস্পষ্ট শোনে তাহলে সে তার চারপাশে থাকা মানুষ জন জিনিসপত্রের নাম ও জানতে পারেনা৷ ফলত তার পক্ষে বলাও সম্ভব হয় না ৷ উলটোদিক থেকে শিশুরা কথা বলতে দেরি করলে এই দিকেও সচেতন হওয়া দরকার যে সে ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছে কিনা।
৫. উদ্দীপনার অভাব
বাবা মা বা তার চারপাশের মানুষজন শিশুটির সাথে নিয়মিত কথা না বললে, তাকে প্রশ্ন না করলে, পরিবেশের সাথে তাকে না মেশালেও কথা বলতে দেরি করে বাচ্চারা।
৬. অটিজম
অটিজমের ক্ষেত্রে একটি শিশুর কিছু আচরণগত সমস্যার পাশাপাশি দেখা দেয় দেরিতে কথা বলার সমস্যাও। অটিজম আক্রান্ত শিশুটি সামাজিকভাবে মেলামেশা করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সে কথা বলতেও পারে। আবার একেবারে কথা নাও বলতে পারে। কথা বললেও হয়তো গুছিয়ে বলা হয়ে ওঠে না। তবে শিশুদের দেরিতে কথা বলার একটি অন্যতম কারণ অবশ্যই অটিজম।
কিছু স্নায়ুঘটিত রোগ বাচ্চাদের কথা বলার জন্য প্রয়োজনীয় মুখের পেশীকে প্রভাবিত করে। ফলে সমস্যা দেখা দেয় কথা বলার ক্ষেত্রে। যেমন সেরিব্রাল পালসি, মাসকুলার ডিসট্রফি, ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি ইত্যাদি।
শিশুর কথা বলতে দেরি হলে কী কী উপায়ে তার সমাধান সম্ভব
স্পিচ এবং ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি
শিশুদের কথা বলতে না পারার সমস্যার সর্বপ্রথম চিকিৎসা পদ্ধতিই হলো এই স্পিচ থেরাপি ৷ এটি এক ধরনের বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা, যার সাহায্যে কথা বলতে অক্ষম অথবা স্বাভাবিক কথা বলতে পারে না, এমন শিশুদের ওপর প্রয়োগ করা হয়। শিশুদের দেরিতে কথা বলা, জিভে কথা আটকানো, তোতলামি, কানে কম শোনার ফলে কথা বলার সমস্যা, ইত্যাদি নানা কারণেই যারা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না, তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর হয় এই স্পিচ থেরাপি।
• বাচ্চা যখন থেকে প্রথম কথা বলার চেষ্টা করা শুরু করবে, সে সময় পরিবারের সকলকেই বাচ্চাটিকে বেশি করে সময় দিতে হবে। শিশুটির আধো বুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মা, বাবা এবং পরিবারের বাকি সদস্যদেরও তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবে কথা বলার সময় অবশ্যই স্পষ্ট এবং শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলবেন। বাচ্চারা যা শোনে সেটাই মনে রেখে বলার চেষ্টা করে।
• বাচ্চাকে প্রথম থেকে আসতে আসতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চেনাতে হবে। দেড় বছরের পর থেকে বিভিন্ন রঙিন বই নিয়ে বইয়ের মধ্যেকার ছবিগুলোর নাম স্পষ্ট উচ্চারণে বলতে হবে তার সামনে। সেক্ষেত্রে বাচ্চা শুনে শুনে তাড়াতাড়ি কথা বলা শিখবে।
• বাচ্চারা কোনো কথা ঠিকভাবে বলতে না পারলে তা নিজের মতো করেই উচ্চারণ করে কথা বলার সময়। প্রাথমিক অবস্থায় তা শুনতে ভালো লাগলে সবাই তার সাথে তাল মিলিয়ে ভুল উচ্চারণেই শব্দগুলো বলে থাকেন। কিন্তু এতে করে কিন্তু শিশুটির কথা বলার পাঠই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাচ্চারা ভুল বললে বড়রা সেটা অবশ্যই ঠিক করে বলবেন, তাতে শিশুটি শুনতে শুনতে একসময় ঠিক উচ্চারণই করবে।
• শিশুরা খেলার ছলেও অনেক কিছু শেখে। সেক্ষেত্রে তাদের সঠিক খেলনা বাছাই করাও কিন্তু কথা বলা শেখানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি৷ রঙিন বই, পাজল, বিভিন্ন লোগো, কিচেন সেট ইত্যাদি তাদের চিনতে শেখান। খেলনাগুলোর কোনটা কী রং সেটাও বারবার বলবেন। নানারকম ফুল, ফল সব্জির রঙ ও নাম চেনান বাচ্চাকে৷
• বাচ্চার সাথে কথা বলার পর, তাকে উত্তর দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিন।
শিশুকে কথা না বলতে পারার জন্য বা ভুল বলার জন্য একেবারেই বকবেন না। এতে শিশুর মধ্যে ভয় এবং জড়তার সৃষ্টি হয়, ফলে পরবর্তীতে সে কথা বলতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তার আত্মবিশ্বাসও নষ্ট হয়। কথা বলার সাথে সাথে বাচ্চাকে বারবার নানা ধরণের ছড়া বা ঘুমপাড়ানি গান শোনাতে হবে।
• বাচ্চা কী খাবে, কোন জামাটা পরবে এগুলো তাদের জিজ্ঞেস করুন। তাদের পছন্দ টা বলার সুযোগ দিন।
• বাচ্চা দু’বছর অব্ধি কথা না বললে সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, প্রয়োজনে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী স্পিচ থেরাপির সহযোগিতা নিন।