এআরটি বহু নিঃসন্তান দম্পতির মুখে ফুটিয়েছে হাসি। তবে আগে পুরনো প্রযুক্তিতে ব্যর্থতার সম্মুখীনও হতে হতো কোনও কোনও দম্পতিকে। এখন প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে এআরটি-এরও উন্নতি হয়েছে। ফলে সাফল্যের হারও বেড়েছে। কোনও দম্পতি ১ বছর ধরে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে সন্তান ধারণে অক্ষম হলে তখন দেখতে হয় কেন ওই দম্পতির সন্তান আসছে না। সন্তান না আসার পিছনে একাধিক কারণ থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর গুণগত মান খারাপ হলে আসতে পারে বন্ধ্যাত্ব। আবার ওভারির সমস্যা, ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লকেজের মতো সমস্যাও দায়ী থাকে। এই ধরনের সমস্যার সমাধান হতে পারে আর্টিফিশিয়াল রিপ্রোডাকশন টেকনোলজি (এআরটি)।
কীভাবে আধুনিক প্রযুক্তিতে নিঃসন্তান দম্পতি সন্তানধারণ করে ?
ইনট্রাসাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইঞ্জেকশন (আইসিএসআই): শুক্রাণুর সমস্যার জন্যও কোনও কোনও দম্পতির সন্তানলাভে সমস্যা হয়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় স্পার্ম কাউন্ট খুব কম। এই সমস্ত ক্ষেত্রে বায়োপ্সির মাধ্যমে টেস্টিস থেকে স্পার্ম বের করে আইভিএফ করা যায় (টেস্টিকিউলার স্পার্ম এক্সট্রাকশন)। এরপর ইঞ্জেকশনের মধ্যে শুক্রাণু নিয়ে সূক্ষ্ম সুচের মাধ্যমে ডিম্বাণুর মধ্যে স্পার্ম প্রবেশ করানো হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে আইসিএসআই। স্পার্ম কাউন্ট কম আছে এমন ব্যক্তি বা স্পার্মের সচলতা কম আছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি লাভজনক।
লেজার অ্যাসিস্টেড হ্যাচিং: শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেকের পর ব্লাস্টোসিস্ট দশায় বিভাজন হওয়া কোষের বাইরে এক ধরনের শেল বা খোল থাকে। চিকিৎসা পরিভাষায় এই শেলকে ‘জোনা পেলুসিডা’ বলে। এই শেল বা খোল ভেদ করে ভ্রূণটি। তবে ভ্রূণের বাইরের আবরণ খুব মোটা হলে এমব্রায়ো ইমপ্ল্যান্ট অনেকক্ষেত্রে সফল হয় না। ঘটে আইভিএফ ফেলিওর। আইভিএফ ফেলিওর এড়ানোর জন্য, জরায়ুতে ভ্রূণ বসানোর আগে লেজারের সাহায্যে, ভ্রূণের বাইরের পুরু আবরণকে পাতলা করে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিকে বলে লেজার অ্যাসিস্টেড হ্যাচিং। এর ফলে বাড়ে ভ্রূণ স্থাপনে সাফল্য।
এগ ফ্রিজিং: ৩০ বছর বয়সের পর থেকে মহিলাদের শরীরে নানা ধরনের হরমোনের পরিবর্তন হয়। এর ফলে ডিম্বাণুর গুণগত মানেরও পরিবর্তন ঘটে। এরপর ৩৫ বছর বয়সের পর থেকে স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান ধারণ ক্রমশ জটিল হতে থাকে। আর ৪০ পেরনোর পর সন্তানধারণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এদিকে আজকাল সকলেই চাইছেন কেরিয়ারে উন্নতি করে তারপর সন্তান নিতে। ফলে ৩৫ বছরের আগে বিয়ে করা বা সন্তান নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওদিকে এমন বয়সে ডিম্বাণুর গুণগত মান হয়ে পড়ে খারাপ। এমন মহিলারা চাইলে কম বয়সে এগ ফ্রিজিং পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারনে। এই প্রক্রিয়ায় একজন মহিলার ওভারি থেকে সুস্থ স্বাভাবিক ওভাম বা ডিম্বাণু সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে রাখা হয় ল্যাবরেটরিতে। এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে বলে এগ ফ্রিজিং। ফলে বছর পাঁচেক বা ছয়েক পরে ওই মহিলা মা হতে চাইলে আইভিএফ প্রক্রিয়ায় সাফল্যের হার অনেক বেশি হয়। কারণ ডিম্বাণু ফ্রিজিং প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত ওভামের গুণগত মান অটুট থাকে।
এছাড়া অনেকের ক্যান্সার ধরা পড়ে। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির মতো দীর্ঘ চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সাহায্য নিতে হয়। কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি ডিম্বাণুর ক্ষতি করে। ফলে ক্যান্সারের রোগীরাও চিকিৎসা শুরুর আগে এগ ফ্রিজিং পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারেন। চিকিৎসা প্রক্রিয়া শেষ করার পরে তাঁর সংরক্ষিত ওভামের সাহায্যে মা হতে পারেন। এখন ডিম্বাণুর সঙ্গে স্পার্মও সংরক্ষণ করা যায়।
ব্লাস্টোসিস্ট কালচার: ওভাম এবং স্পার্ম মিলিত হয়ে শুরু হয় ভ্রূণ তৈরির প্রক্রিয়া। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন হওয়ার পরবর্তী ৫ থেকে ৯ দিনের মধ্যে ভ্রূণটি ইউটেরাসে বসে যায়। নিষেক হওয়া থেকে শুরু করে ইউটেরাসে প্রোথিত হওয়া পর্যন্ত অবস্থাকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ‘ক্লিভেজ’ এবং ‘ব্লাস্টোসিস্ট’ দশা। আইভিএফ প্রক্রিয়ায় চিকিৎসকরা সাধারণত একাধিক ভ্রূণ তৈরি করেন। আগে, ভ্রূণ তৈরির পর ‘ক্লিভেজ’ দশাতেই ইউটেরাসে ভ্রূণ বসিয়ে দিতেন। কিন্তু তাতে এমব্রায়োগুলির মধ্যে কোনটি বেশি সুস্থ বা কোন ভ্রূণের বৃদ্ধি ভালো হচ্ছে তা জানার সুযোগ ছিল না। বর্তমানে পরীক্ষাগারে ব্লাস্টোসিস্ট কালচারের সাহায্যে ভ্রূণের বৃদ্ধি কেমন হচ্ছে তা জানা সম্ভব। তাই এখন একাধিক ভ্রূণের মধ্যে শুধুমাত্র সুস্থ এবং স্বাভাবিক ভ্রূণ নির্বাচন করে সেই ভ্রূণকেই ইউটেরাসে স্থাপন করা হচ্ছে। এর ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে আইভিএফ পদ্ধতিতে সাফল্যের হার।
প্রিইমপ্ল্যান্টেশন জেনেটিক টেস্টিং অব অ্যানিউপ্লয়ডিস (পিজিটিএ): ৩৮ বা তার বেশি বয়সে সন্তান এলে ভ্রূণে জিনগত কিছু সমস্যা হওয়ার ভয় থাকে। এছাড়া যাঁদের বারবার মিসক্যারেজের ইতিহাস থাকে তাঁদের ক্ষেত্রেও ভ্রূণে জিনগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই বেশি বয়সে আইভিএফ করাচ্ছেন বা আগে একাধিকবার মিসক্যারেজ হয়েছে এমন মহিলার ইউটেরাসে ভ্রূণ স্থাপন করানোর আগেই, পিজিটিএ পরীক্ষার মাধ্যমে এমব্রায়োর জিনগত ত্রুটি নির্ধারণ করা যায়। আগেই বলা হয়েছে, আইভিএফ পদ্ধতিতে একাধিক এমব্রায়োর তৈরি করা হয়। ফলে একাধিক ভ্রূণের মধ্যে যেগুলি সুস্থ, শুধুমাত্র সেগুলিকেই ইউটেরাসে প্রতিস্থাপন করা হয়।