ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস কি ? এই নীরব ঘাতক রোগটির সম্পর্কে জানার আগে এটা বুঝে নেওয়াটা ভীষণ প্রয়োজন। বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস হল একটি পুস্টিগত বিপাকীয় সমস্যা। অগ্ন্যাশয়ের বিটাকোষ থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন হরমোনের ঘাটতি থেকেই এই ডায়াবেটিসের উৎপত্তি। রক্তে শর্করার বিপাক থেকেই শক্তির উৎপত্তি হয়। কোষের এই শর্করার বিপাক ক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা নেয় ইনসুলিন। এই ইনসুলিন হরমোন এর নিঃসরণ যদি কম হয় কিংবা টার্গেট কোষে ইনসুলিন গ্রাহকের সংখ্যা কম হলে শরীরে কার্বোহাইড্রেট বিপাক ক্রিয়া ব্যাহত হয় । এজন্য ডায়াবেটিস রোগী দের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়।
ভারতীয় রোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিস কি দিন-দিন বাড়ছে?
বর্তমান বিশ্বের মোট ডায়াবেটিক রোগীর ২০% ভারতীয়। যে কারণে ভারতকে ডায়াবেটিসসের রাজধানী বলা হয়, সমীক্ষায় দেখা গেছে , কঠোর পরিশ্রমী মানুষেরা যেখানে ২.৮% এই রোগে শিকার হচ্ছে সেখানে উদাসীন জীবন যাত্রায় অভ্যস্থ মানুষের আক্রান্ত সংখ্যা ৪৮.৩%.
বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস এর লক্ষণ হল:
- খুব বেশি জল পিপাসা পাওয়া।
- খাবার ইচ্ছে বেড়ে যাওয়া।
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
- শরীরের ওজন কমে যাওয়া।
- সহজেই ক্লান্তি অনুভব করা।
- শরীরের কোথাও কেটে গেলে সেটি সারতে সময় লাগা।
বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস বিভিন্ন প্রকার হতে পারে যেমন
ইনসুলিন নির্ভর বহুমূত্র বা টাইপ 1 ডায়াবেটিস, যা সাধারণত শৈশবে ও কৈশোরে দেখা যায়
ইনসুলিন নিরপেক্ষ বহুমূত্র বা টাইপ 2 ডায়াবেটিস, ৮৫ _ ৯০% ব্যক্তির এই ধরনের ডায়াবেটিস এ ভোগেন।
অপুষ্টিজনিত বহুমূত্র।
গর্ভাবস্থায় শতকরা ১ভাগ মহিলার ডায়াবেটিস দেখা যায়।
শারীরিক স্থূলতা, নিয়মিত শরীর চর্চার অভাব, বংশপরম্পরা, অনুপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস ( বেশি পরিমাণে বিশুদ্ধ কার্বোহাইড্রেট এবং চর্বি জাতীয় খাদ্য খাওয়া) , অণুজীব সংক্রমণ, আমাদের দেশে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস রোগের মূল কারণ । এছাড়াও উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা এই রোগের অন্যতম কারণ।
কখন ডায়াবেটিক বলবো?
সাধারণ লোকের ১২ ঘণ্টা অভুক্ত থাকার পর রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমাণ হয় প্রতি ১০০মিলিলিটার রক্তে ৮০- ১১০ মিলিগ্রাম। এবং খাদ্য গ্রহণের ২ ঘণ্টা পর, প্রতি ১০০ মিলি লিটার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হয় ১৪০মিলিগ্রাম। যখন অভুক্ত অবস্থায় গ্লুকোজর পরিমাণ প্রতি ১০০ মিলি লিটার রক্তে ১১০মিলিগ্রামের বেশি ও খাদ্য গ্রহণের ২ ঘণ্টা পর গ্লুকোজের পরিমাণ ১৪০ মিলিগ্রামের বেশি হয় তখন তাকে ডায়াবেটিক বলা হয়।
বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস রোগের জটিলতা
বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যাঙ্গর কাজ কে প্রভাবিত করে এবং শরীরের জটিলতা তৈরি করে। দেখা গেছে , রক্তে শর্করার ( গ্লুকোজ) পরিমাণ দীর্ঘদিন ধরে বেশি থাকলে রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড ও কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং হৃদযন্ত্রের অসুখের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। অনিয়ন্ত্রিত রক্ত শর্করা কিডনির রক্ত নালিকায় আঘাত করে কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয় যা আমাদের উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে, এবং কিডনি কে দুর্বল করে তোলে।
ইনসুলিনের মাত্রা কম হলে শর্করার দহন ব্যাহত হয় ফলে শক্তির জন্য অতিরিক্ত পরিমাণ ফ্যাট এবং প্রোটিন এর দহন বৃদ্ধি পায় আর তৈরি হয় কিটোন পদার্থ ও বর্জ্য পদার্থ যা আমাদের দুর্বল কিডনি ছাকতে পারেনা এবং বর্জ্য পদার্থ রক্তের মধ্যেই জমে গিয়ে বিষ ক্রিয়া শুরু করে। একে বলে ইউরেমিয়া। এছাড়াও রক্তের শর্করা বেড়ে গেলে চোখের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অংশ রেটিনাকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার ফলে অন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে ধীরে-ধীরে আকেজ করে দিয়ে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার কারণে একে “নীরব ঘাতক” ও বলা হয়।
বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস রোগের প্রতিকার:
এই রোগে ইনসুলিন হরমোনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়, তাই আমাদের সবসময় এমন খাবার গ্রহণ করতে হবে যা ইনসুলিনের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ,রক্তে শর্করার পরিমাণ ঠিক রাখবে। ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে জরুরী সময়মত স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাদ্য নির্বাচন তার সাথে হাঁটাচলা, ও পরিমাণমত জল পান করা। বহুমূত্র রোগীর খাদ্য একজন সাধারণ লোকের খাদ্যের থেকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে হয় না। ডায়াবেটিক রোগীর পুষ্টি র চাহিদা একজন সাধারণ মানুষের মতই হয়ে থাকে। তবে ,দৈনিক খাদ্য তালিকায় বিশুদ্ধ কার্বোহাইড্রেট ( চিনি, মধু, গুড়, ময়দা, মিষ্টি)-র পরিবর্তে রাখতে হবে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য যা আমাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ আস্তে আস্তে বৃদ্ধি করবে এবং ডায়াবেটস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য গুলি পাওয়া যায় ভাত, গম, যব, রাই, মিলেট জাতীয় খাবার থেকে। তবে তা সঠিক অনুপাতে নিতে হবে ।
ডায়াবেটিক রোগীরা যেসব খাদ্য যথেষ্ট পরিমাপে খেতে পারেন ত হলো – সবুজ শাক-সবজি, ফল( কলা, আতা, সবেদা ব্যতিরেকে) লেবু, স্যালাড, মাখন তোলা বা ফ্যাটমুক্ত দুধ, ঘোল, মশলাপাতি। এছাড়া অল্প পরিমাণে শস্য দানা, ডাল, মাংস, ডিম, বাদাম ইত্যাদি খেতে পারেন ।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, হলুদ, পেয়াজ, রসুন, মেথি খুব ভালো ইনসুলিন হরমোনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে যার ফলে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে, তাই দৈনিক খাদ্য তালিকায় এগুলো রাখা ভালো। পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা ও চিকিৎসকের পরামর্শ আপনাকে ডায়াবেটিস নামক নীরব ঘাতক থেকে নিরাপদ থাকতে সাহায্য করবে।