এনজিওপ্লাস্টির পর ডায়েট কি হবে ? এরপর নিজেকে সুরক্ষিত থাকতে কি করবেন তাই নিয়ে চিন্তিত ? মুশকিল আসান করতে খাদ্য তালিকায় কি রাখবেন আর কোনটাই বা বাদ দেবেন তা সবিস্তারে জানালেন আমাদের পুষ্টিবিদ প্রমিতা সাহা। কিন্তু তার আগে জেনে নেওয়া যাক এনজিওপ্লাস্টি কি?
এনজিওপ্লাস্টি বর্তমানে বহুল প্রচলিত এক উন্নত মানের চিকিৎসা পদ্ধতি যা করোনারি আর্টারিতে ঘটে যাওয়া ব্লকেজ দুর করে। করোনারি আর্টারি হল সেই আর্টারি যে হৃদপিণ্ড থেকে বিশুদ্ধ রক্ত সারা শরীরে সরবরাহ করে। কিন্তু অনুন্নত কিছু জীবনযাত্রা, ভুল খাদ্য নির্বাচন আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ করোনারির মধ্যে চর্বির প্রলেপ তৈরী করে রক্তবাহের পথকে সঙ্কীর্ণ বা সরু করে দেয় যার ফলে রক্ত সরবরাহের ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত। এমন মারাত্মক রোগের থেকে চটজলদি মুক্তি পেতে চিকিৎসা জগতে উন্নতমানের একটি পদ্ধতি হল এনজিওপ্লাস্টি। যা অপেক্ষাকৃত সরু ক্যাথেটার কব্জির রেডিয়াল আর্টারি বা থাই/কুঁচকির কাছে থাকা ফিমোরাল আর্টারির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে, করোনারি আর্টারির যে অংশ সরু হয়ে রক্ত সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করে সেই অংশ উন্মুক্ত ও প্রসারিত করে রক্ত সরবরাহ স্বাভাবিক করে তোলে। এই পদ্ধতি চটজলদি রোগের উপশম করতে পারে ঠিকই তবে এই পদ্ধতি রোগের পুরোপুরি বিনাশ ঘটায় না , পরবর্তী সময়ে তার আবার ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায় । তাই তার সাথে মনে রাখতে হবে যে ভবিষ্যতে যেন আর এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয় তার জন্য আমাদের প্রধান দুটি বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে।
প্রথমত – এনজিওপ্লাস্টিএর পর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ওষুধ সময় মত নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত – অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার পরিবর্তন করতে হবে। এখানে জীবনযাত্রার পরিবর্তন মানে শুধুমাত্র খাদ্য নয় তার সাথে নিয়মিত শরীর চর্চাও করতে হবে।
এছাড়াও বেশ কিছু নিয়ম মেনে চললে আপনি ভবিষ্যতের সমূহ বিপদ থেকে সহজেই দুরে থাকতে পারেন।
এনজিওপ্লাস্টির পর ডায়েট বা খাদ্য তালিকায় কি কি রাখবেন?
শস্য বা দানা জাতীয় খাদ্য
যদি শারীরিক ওজন, উচ্চতা অনুয়ায়ি স্বাভাবিক থাকে তবে ২০০ গ্রাম শস্য রাখা যেতে পারে। যদি উচ্চতার পরিপ্রেক্ষিতে ওজন বেশি থাকে তবে সেক্ষেত্রে শস্য বা দানা জাতীয় খাদ্য তালিকায় কম পরিমাণে রাখতে হবে। এই শস্য বা দানা জাতীয় খাদ্যগুলি হলো ভাত, রুটি, চিঁড়ে, মুড়ি, ইত্যাদি।
তেল বা চর্বি জাতীয় খাদ্য:
তেল বা চর্বি হার্টের জন্য একেবারেই আদর্শ নয় তাই ঘী, ডালডা ও মাখন খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিন পাশাপাশি ফাস্টফুড জাতীয় খাবার থেকে দুরে থাকুন। রান্নার সময়ও তেলের ব্যাবহার কমিয়ে ফেলুন। সম্ভব হলে একরকম তেল ব্যবহার করার পরিবর্তে ২ থেকে ৩ রকম তেল মিশিয়ে রান্না করুন। রান্নার কাজে একই তেল বার-বার গরম করলে তেলে একরকম বিশেষ ক্ষতিকর যৌগ তৈরি হয় যা শুধু হার্টের পক্ষে ক্ষতিকর নয় এর থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। তাই একই তেল বার বার গরম করা যাবেনা।
মাছ, মাংস ও ডিম
সব ফ্যাট হার্টের জন্য ক্ষতিকর নয়, বিশেষত মাছে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড আপনার হার্টের জন্য উপকারী। সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি যেকোনো ছোটো মাছ যেমন চারাপনা, পুটি, ট্যাংরা, পার্সে, শিং, মাগুর, তেলাপিয়া, খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন রাখা যেতে পারে । সপ্তাহে দুবার তৈলাক্ত জাতীয় মাছ যেমন- রুই, কাতলা, বোয়াল, ইলিশ ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় রাখা যাবে।
সপ্তাহে ২ থেকে ৩দিন মুরগির মাংস রাখা যেতে পারে। তবে ছাগল, ভেড়া, শুয়োরের মাংস খাদ্য তালিকায় রাখা যাবেনা।
ডিম থেকে আমারা উচমাত্রায় প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ৬, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ইত্যাদি পাই যা আমাদের শরীরে নানা কাজে সহায়তা করে তাই সপ্তাহে ২ থেকে ৩ টে ডিম খাদ্য তালিকায় রাখা যেতে পারে।
দুধ বা দুধজাত সামগ্রী
মাখন ছাড়া বা ফ্যাট বিহীন দুধ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় মাখন ছাড়া দুধের তৈরী সামগ্রী দই, ছানা ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফল ও সবুজ শাক সবজি
প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম ফল গ্রহণ করা যেতে পারে। খাদ্য পেয়ারা, নাশপাতি, পেঁপে, আনারস, জাম, লেবু জাতীয় ফল ইত্যাদি রাখা আবশ্যক।
সবজিতে উচ্চ মাত্রায় ফাইবার ছাড়াও আছে অনেক পুষ্টি গুন। সবজিতে আছে হার্ট ফ্রেন্ডলি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ক্লোরোফিল যা রক্ত থেকে দূষিত পদার্থ বের করতে সাহায্য করে। এছাড়াও সবুজ শাক-সবজিতে আছে ভালো মানের পটাসিয়াম, যা শরীরে সোডিয়াম মাত্রা কমিয়ে রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে। তাই খাদ্য তালিকায় প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাক-সবজি রাখা উচিত।
এনজিওপ্লাস্টি -র পর নিয়মিত শারীরিক চর্চা করুন
নিয়মিত শারীরিক চর্চা শুধু মাত্র নিজেকে ফিট রাখে না, আপনাকে হৃদ রোগ থেকে বাঁচাতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম আপানার হার্ট ও ফুসফুসের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে ফলে রক্ত চলাচলে কোনো বাধা পড়েনা। রক্ত সহজেই ধমনী দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্যের সাথে শরীর চর্চা করা উচিত। প্রথমে খুব অল্প অল্প করে শুরু করতে হবে, যেমন সকালে কিছুক্ষন বাগানে হাটা, বিভিন্ন সহজ যোগ ব্যায়াম করা, কিন্তু কখনো ভারী কিছু বহন করা যাবেনা এতে বিপদ হতে পারে। ধীরে-ধীরে হাঁটাচলার পরিমাণ ও সময় বাড়াতে হবে। এর সাথে প্রাণায়াম, সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা যেতে পারে।
ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করুন
এনজিওপ্লাস্টির পর আপনার হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনার। ধূমপান ও মদ্যপান শুধু ক্যান্সারের কারণ নয় আনার হৃদরোগের জন্যও সমান ভাবে দায়ী তাই ধূমপান ও মদ্যপান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করুন।
স্ট্রেসমুক্ত জীবন ও পর্যাপ্ত ঘুম
বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে জীবন জটিল হতে থাকে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে স্ট্রেস । এই স্ট্রেস থেকে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মতন সমস্যা গুলি শরীরের ভেতরে বাসা বাঁধতে থাকে, এরপর ঘুমের পরিমাণ কমে এলে তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে, তাই যেকোনো বয়সের মানুষের জন্য স্ট্রেসমুক্ত জীবন ও পর্যাপ্ত ঘুমের একান্ত প্রয়োজন। যাদের একবার এনজিওপ্লাস্টি হয়ে গেছে তাদের জন্যও ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম অবশ্যই দরকার।