গলব্লাডার স্টোন বলতে কী বোঝায়?
বাংলায় গলব্লাডারের অর্থ হল পিত্তথলি। লিভারের সঙ্গে যুক্ত থাকা একটি অঙ্গ হল পিত্তথলি। লিভার থেকে বেরয় বিভিন্ন ধরনের বাইল। বাইলের রিজার্ভারকে বলে গলব্লাডার বা পিত্তথলি। যখনই আমরা খাদ্যগ্রহণ করি, তখনই পিত্তরস বা বাইল প্রথমে পিত্তথলিতে জমা হয়। এরপর পিত্তথলি থেকে পিত্তনালীর মাধ্যমে খাদ্যনালীতে আসে। এভাবেই পিত্তথলি আমাদের খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। তবে পিত্তথলিতে বাইল জমা হয় খুব সামান্যই। অথচ এই পিত্তথলিতেই তৈরি হয় পাথর। পাথর বিভিন্ন রকমের হয়— কোলেস্টেরল স্টোন, পিগমেন্ট স্টোন, মিক্সড স্টোন। তবে সব থেকে বেশি হয় কোলেস্টরল স্টোন এবং মিক্সড স্টোন। পিগমেন্ট স্টোন কিছু নির্দিষ্ট অসুখের ক্ষেত্রে হয় যেমন হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া, থ্যালাসিমিয়ার রোগী ইত্যাদি। কেন পিত্তথলিতে স্টোন তৈরি হয়?
কোনও ফ্যাটজাতীয় কোনও খাদ্য খাই, তখন সেই খাদ্যে থাকা ফ্যাট, কোলেস্টেরল শোষিত হয় পিত্তরসের মাধ্যমে। আবার প্রয়োজন মতো শরীর থেকে ফ্যাট বেরিয়েও যায়।
এই পদ্ধতির মধ্যে যখন একটা ভারসাম্যহীনতা দেখা হয়, তখনই স্টোন তৈরি হতে থাকে। পিত্তথলিতে স্টোন গড়ে ওঠার অনেকগুলি কারণের মধ্যে এই হল একটি কারণ। পিত্তরসের মধ্যে কিছু অম্লধর্মী উপাদান বা অ্যাসিড থাকে তা ঘনীভূত হয়ে তৈরি হয় স্টোন। অবশ্য তার মধ্যে সংক্রমণযোগ্য কিছু বিষয়ও দায়ী থাকতে পারে। সেই স্টোন বিভিন্ন ধরনের হয়। স্টোন একটি হতে পারে, একাধিক ও হতে পারে। আবার স্টোন তৈরির আগে একটা কাদার মতো জিনিস তৈরি হয় যাকে ‘স্লাজ’ বলে।
কাদের হয় গলব্লাডার স্টোন
আমাদের এখন যা খাদ্যভ্যাস বা লাইফস্টাইল, ততে দেখা যাচ্ছে গলস্টোন খুব সাধারণ এবং অতিপরিচিত একটা অবস্থা। বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ সকলেরই এমন হতে পারে। তবে তার মধ্যেও সবচাইতে বেশি যাঁদের বলা হয় তাঁরা হচ্ছে, প্রজননক্ষম বয়সের মহিলা, বিশেষ করে যাঁদের বয়স ৪০ বছরের মধ্যে তাঁদের অনুপাত অনেক বেশি। তার পিছনে নানা ধরনের হরমোনাল কারণ একটা অন্যতম অংশ।
আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো, তা হল নানা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মধ্যে গলব্লাডারে স্টোন বেশি। তবে কেন এমন ঘটনা ঘটে তার নির্দিষ্ট কোনও কারণ এখনই বলা যাচ্ছে না।
আবার দক্ষিণ ভারত বা পশ্চিম ভারতে গলস্টোনের ঘটনা যথেষ্ট কম।
আমাদের খাদ্যাভ্যাসে এই সমস্যা অত্যন্ত কমন!
খালিপেটে থাকলে গলব্লাডার স্টোন হয়?
শুধু উপোস করে থাকলেই যে গলব্লাডারে স্টোন হবে এমন কোনও কথা নেই। তবে হ্যাঁ, দু’টি খাবারের মধ্যে যখন সময়ের অন্তর বাড়ে তখন সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এছাড়া অনিয়মিত জীবনযাপন এবং অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের প্রভাবও অস্বীকার করার জায়গা নেই।
গলব্লাডার স্টোনের উপসর্গ
গলব্লাডার স্টোনের শুরু থেকে এবং তার জটিলতা শুরু হওয়া পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন উপসর্গ প্রকাশ পেতে পারে।
প্রাথমিক স্তরে যে ঘটনাগুলি ঘটে সেগুলি হল—
- খাবার খেতে অনীহা • পেটের ওপরের অংশে ভার ভার মনে হয় • সামান্য খেলেই মনে হয় পেট ভরে গিয়েছে • বমি বমি ভাব দেখা দেয় • খাবার খাওয়ার পরেই পেটের ডানদিকের ওপরের অংশে ব্যথা করে • অনেকসময়ে সেই ব্যথা কাঁধ পর্যন্ত চলে যায় • প্রধানত ডান কাঁধে বা কাঁধের পিছনদিকে এমন ব্যথা হতে পারে। এই ধরনের ব্যথা ও সমস্যাও হতে পারে গলব্লাডারের উপসর্গ।
গলব্লাডার স্টোনের জটিলতা
স্টোন পিত্তনালীতে নেমে এলে জন্ডিস হতে পারে। আরও নীচে নেমে গেলে প্যাংক্রিয়াটাইটিস হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। স্টোনের কারণে গলব্লাডারে এক ধরনের সংক্রমণ হয় যাকে অ্যাকিউট কোলেসিস্টাইটিস বলে। তেমন ক্ষেত্রে প্রচণ্ড পেটে ব্যথা, বমি, জ্বর, এরকম সমস্যাও হতে পারে।
কী কী রোগ পরীক্ষা?
প্রাথমিকভাবে পেটের একটা আলট্রাসাউন্ড করাতে হয়। এই আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমের পিত্তথলিতে স্টোন আছে কি না তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তার সঙ্গে কিছু রক্তপরীক্ষাও আমরা করতে দিই।
এগুলির মধ্যে লিভার ফাংশন অন্যতম।
গলব্লাডার স্টোনের চিকিৎসা ও ওষুধ
ওষুধ দিয়ে গলব্লাডার স্টোন সারানো যায় না। ওষুধ দিয়ে স্টোন গলিয়ে দেওয়াও যায় না। এমনকী এই বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্যও আমাদের হাতে নেই। অ্যাকিউট পেইনে ব্যথার ওষুধ দেওয়া দরকার। সংক্রমণ হলে সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। তার সঙ্গে জানতে হয় স্টোন কোন ধরনের। কতগুলি স্টোন আছে ইত্যাদি বিষয়। আর সাধারণভাবে গলব্লাডারের চিকিৎসা হল অপারেশন।
অপারেশনের পদ্ধতি
অপারেশন হয় ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে। অর্থাৎ যাকে সাধারণভাবে আমরা মাইক্রোসার্জারি বলি। এক্ষেত্রে পেটের মধ্যে চারটে ফুটো করে সেই ফুটোর মধ্যে দিয়ে যন্ত্রপাতি প্রবেশ করিয়ে গলব্লাডার থলিকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। মনে রাখবেন, গলব্লাডার বাদ দিলে কোনও সমস্যা হয় না। কারণ পিত্তথলি হল বাইল জমা রাখার সাময়িক জায়গা।
অপারেশনের পর সাবধানতা
এমনিতেই প্রত্যেক মানুষের উচিত সুষম খাদ্যগ্রহণ করা। বিশেষ করে ফ্যাট ও শর্করাজাতীয় খাদ্য এড়িয়ে চলা উচিত। খাওয়া যাবে না খুব বেশি ফ্যাটি ফুড ও কোলেস্টেরল প্রধান খাদ্য। প্রয়োজন প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট এক্সারসাইজ করা। একই কাজ করুন অপারেশনের পরেও। সেদ্ধ খাবার খেতে হবে না। মাছ, মাংস, ডিম, সব্জি সবই খান। শুধু বাড়ির তৈরি খাবারই খান। রেস্তোরাঁর অধিক তেল-মশলা দিয়ে বানানো খাদ্য এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।