হেপাটাইটিস-বি-এর সংক্রমণ লিভার ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কারণ! হেপাটাইটিস বি রোগের লক্ষণ বিষয়ে এখনও বেশিরভাগ মানুষেরই তেমন কোনও ধারণা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ‘হেপাটাইটিস বি ফাউন্ডেশন’-এর মতে হেপাটাইটিস-বি এর চিকিৎসা সঠিক সময় মতো না হলে তা লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।
অনেক সময় রক্তদান করার সময়ে অথবা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করাতে গিয়ে অনেকেরই হেপাটাইটিস বি বা সি ধরা পড়ে। এতে বেশির ভাগ রোগীই ভেঙে পড়েন। কারণ অনেকেরই ধারণা, হেপাটাইটিস বি বা সি মানেই লিভার সিরোসিস বা ক্যানসার অবধারিত। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে মৃত্যু একরকম নিশ্চিত। কিন্তু সত্যিই কি এমনটাই হয়, না কি সংক্রামিত হয়েও চিকিৎসার পর ফিরে আসা যায় সুস্থ জীবনে?
হেপাটাইটিস -বি আসলে কী?
হেপাটাইটিস বি একটি একটি ভাইরাস, এবং এর দ্বারা সৃষ্ট রোগটির নাম হেপাটাইটিস। এটি মূলত যকৃত বা লিভারের প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন সৃষ্টিকারী একটি রোগ। লিভারে ভাইরাসের সংক্রমণের ফলেই মূলত এই রোগ হয়।
হেপাটাইটিস বি ছাড়াও এক্ষেত্রে চিহ্নিত করা গিয়েছে আরও চারটি ভাইরাস। যা পরিচিত হেপাটাইটিস এ, সি, ডি, ই নামে।
এই পাঁচটি ভাইরাসের মধ্যে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসটির বিস্তার এবং সংক্রমণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। তাই এখনও বহু সংখ্যক মানুষ হেপাটাইটিস নামক রোগটিকে ‘হেপাটাইটিস-বি’ নামেই জানেন।
আমাদের শরীরে যকৃত বা লিভারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, রক্তে লোহিত কণিকার আয়ু শেষ হলে, দেহ থেকে তার অন্তর্গত বিলিরুবিনের নিষ্কাশন করা। হেপাটাইটিস ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে যকৃতের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ফলে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে দেহ ক্রমশ হলদেটে হয়ে যায়।
হেপাটাইটিস এর সংক্রমণের কারণ কী?
• হেপাটাইটিস এ এবং ই সংক্রামিত হয় দূষিত খাদ্য এবং পানীয়ের মাধ্যমে।
• হেপাটাইটিস বি, সি, ডি সংক্রামিত হয় মূলত ব্লাড ট্রান্সফিউশন এবং একাধিক বার ব্যবহৃত একই ইঞ্জেকশনের সুচ ব্যবহারের মাধ্যমে।
• ট্যাটু আঁকার সময়েও সতর্কতার অভাবে এই ভাইরাস দেহে প্রবেশ করতে পারে।
• সংক্রামিত মায়ের দেহ থেকে শিশুর মধ্যে হতে পারে ভাইরাসের এই সংক্রমণ।
• সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহৃত ব্লেড, টুথব্রাশ ব্যবহার করলেও হতে পারে হেপাটাইটিসের সংক্রমণ।
• হেপাটাইটিস বি-র রোগির রক্ত যদি অন্য ব্যাক্তি কে দেওয়া হয় তা থেকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে হেপাটাইটিস।
হেপাটাইটিস এর সংক্রমণ থেকে কী কী জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে?
বিভিন্ন ভাইরাল হেপাটাইটিসের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হল হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস দুটি। কারণ এই দু’ধরনের ভাইরাস থেকে সমস্যা চরম পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। আবার এই দু’টি ভাইরাস থেকে ক্রনিক হেপাটাইটিসও হতে পারে। যা পুরোপুরি নিরাময় করা বহু ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ক্রনিক হেপাটাইটিস থেকে লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যানসার হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। ডাক্তারদের মতে ঠিক সময়ে ধরা পড়লে হেপাটাইটিস বি নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন উপসর্গ ঠিক সময়ে ধরা পড়ে না। চিকিৎসা দেরিতে শুরু হলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে।
হেপাটাইটিস বি রোগের লক্ষণ গুলি কী কী?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ দিন যাবত এই রোগের উপসর্গ ধরা পড়ে না। সংক্রমণের পরে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে সময় লাগতে পারে ৩০ থেকে ১৮০ দিন পর্যন্ত।
• ঠান্ডায় কাঁপুনি, জ্বরজ্বর ভাব।
• খিদে না পাওয়া।
• ক্লান্তি, শরীরে ব্যথা।
• সারা গায়ে চুলকানি
• প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসা না হলে জন্ডিস, চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, তীব্র জ্বর, বোন জয়েন্টে যন্ত্রণা, গাঢ় বর্ণের প্রস্রাব, বমি ভাব, বমি হওয়া, গায়ের রং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া — ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
কিভাবে নির্ণয় করা হয় হেপাটাইটিস- বি এর সংক্রমণ?
হেপাটাইটিস নির্ণয় করার জন্য ডাক্তাররা কিছু রক্ত পরীক্ষা, বিলিরুবিন, বিলিভারডিন, এবং লিভার ফাংশন টেস্টের (এলএফটি) পরামর্শ দেন৷
হেপাটাইটিস-বি এর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পদ্ধতি কী?
হেপাটাইটিস-বি এর উপসর্গ দেখা দিলে বা ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা শুরু করা একান্ত প্রয়োজন।
• অ্যাকিউট হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। যেমন — Entecavir (Baraclude), Tenofovir (Viread), Lamivudine (Epivir), Adefovir (Hepsera), Telbivudine (Tyzeka).
• ওষুধ ছাড়াও দেওয়া হয় ইঞ্জেকশন৷ হেপাটাইটিস-বি এর সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে সাধারণত Interferon alfa-2b (Intron A) ইঞ্জেকশনটি প্রয়োগ করা হয়।
তবে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে হেপাটাইটিস বি নেগেটিভ হয়েছে কি না। এ ছাড়া পুরোপুরি সুস্থ হলেও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে দীর্ঘদিন।
ক্রনিক হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে নিয়মিত চলবে চিকিৎসা। চিকিৎসকের পরামর্শের বাইরে কিছু করা যাবে না। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সম্পূর্ণ বিশ্রাম। নজর দিতে হবে খাওয়াদাওয়া তেও।
হেপাটাইটিস বি-এর টিকাকরণ
হেপাটাইটিস বি-এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছোটোবেলাতেই দেওয়া হয়। এটি নিলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে প্রথমে তিনটি ডোজ় এক মাস অন্তর দিতে হয়। চতুর্থ টিকা দিতে হয় প্রথম ডোজ়ের ঠিক এক বছর পরে। পাঁচ বছর পর প্রয়োজন হয় বুস্টার ডোজের।
কী খাবেন?
• একেবারেই তেলমশলা যুক্ত খাবার খাওয়া চলবে না। সহজ পাচ্য খাবার রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়।
• গ্লুকোজ় শরবত রোজ খেলে উপকার পাওয়া যায়।
• এ সময়ে শরীরকে যতটা সম্ভব ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। তাই আখের রস, ডাবের জল, মৌরি-মিছরি ভেজানো জল খাওয়া উচিত।
• বেশি করে ফল, সবজি খাওয়া ভাল।