ভাইরাস থাবা বসালে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আক্রান্ত হয় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সেরকম একটি ভাইরাস হলো হারপিস।এটি দুই ধরণের – হারপিস জোস্টার ভাইরাস এবং হারপিস সিম্পলেক্স।এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, সংক্রমণের ধরণও ভিন্ন। চরিত্রের দিক থেকে হারপিস সিমপ্লেক্সের তুলনায় অনেকটাই আলাদা হারপিস জোস্টার।
হারপিস জোস্টারকে এক কথায় বলতে গেলে এটি একটি ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ। জলবসন্ত বা চিকেনপক্সের জন্য দায়ী যে ভাইরাস, সেটিই হারপিস জোস্টার। সম্পূর্ণ নাম ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস। শুধু চিকেন পক্সের ক্ষেত্রে এর সংক্রমণ প্রাথমিক এবং বহিরাগত।
কিভাবে ঘটে হারপিস জোস্টারের সংক্রমণ? সংক্রমণের কারণই বা কী?
ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস (VZV) প্রাথমিকভাবে সংক্রমণের পর ত্বক থেকে সোজা চলে যায় সেন্সরি নার্ভ এন্ডিং-এ।সেখান থেকে সেন্সরি ফাইবার বেয়ে পৌঁছায় সেন্সরি গ্যাংলিয়াতে। এই গ্যাংলিয়াগুলি আসলে বহু স্নায়ু-কোষতন্তু গুলির একত্রিত সমাবেশ। ভাল মানুষের মতো সেন্সরি গ্যাংলিয়াতে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে এই ভাইরাস। এই অবস্থাকে বলে লেটেন্ট স্টেট। এই নিষ্ক্রিয় অবস্থা বা নিদ্রা-দশা চলতে পারে বহু বছর। তারপর একদিন হঠাৎ করেই সংক্রিয় হয়ে ওঠে ভ্যারিসেলা জোস্টার ভাইরাস (VZV)। এবং গ্যাংলিয়ার শয্যা ছেড়ে স্নায়ু তন্তু বরাবর নেমে এসে আক্রমণ করে ত্বকে। এবার এই ভাইরাসের সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত হয় সাধারণত একটি বা দুটি ডার্মাটোমে। ডার্মাটোম হল ত্বকের সেই নির্দিষ্ট অংশ যার সংবেদনশীলতা নির্ধারিত হয় একটি নির্দিষ্ট নার্ভের দ্বারা। কিন্তু, হঠাৎ করে কেনই বা সক্রিয় হয়ে ওঠে এই ভাইরাস? এর কারণ হতে পারে কোনো আঘাত, বা অতিরিক্ত পরিশ্রম, ক্লান্তি, অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতা, অথবা হতে পারে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় এমন কোনো ওষুধের ব্যবহার কিংবা মেরুদণ্ডে রেডিয়েশনের প্রয়োগ ইত্যাদি। এছাড়াও চিকেনপক্স রোগীর সংস্পর্শে এলেও ভাইরাসটি পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
তবে একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, যাঁদের কোনোদিনও চিকেন পক্স হয়নি, তাঁদেরও হতে পারে হারপিস জোস্টার সরাসরি সংক্রমণে। তবে তুলনামূলক কম সংক্রামক এই জোস্টার ভাইরাস।
হারপিস জোস্টার সংক্রমণের লক্ষণগুলি কী কী?
• ছোটো ছোটো ফুসকুড়ি বা র্যাশ, এবং তাতে প্রবল যন্ত্রণা।
• জল ভর্তি ফোসকা৷
• কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্ত ভরা ফোসকা।
• আক্রান্ত স্থানে প্রবল যন্ত্রণা।
• জ্বর ও গা ম্যাজ ম্যাজ।
• মাথা ব্যাথা।
• কোমরে ব্যথা।
• খুশখুশে কাশি।
• মানসিক অবসাদ।
এরকম হতে পারে যে হার্পিস জোস্টার ভাইরাস সংক্রমণ রোগের শারীরিক লক্ষণ দেখা না দিলেও তা রোগীর দেহে বিদ্যমান থাকতে পারে।
হারপিস জোস্টারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কাদের বেশি থাকে? কী কী জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে?
কারা আক্রান্ত হতে পারে, এটা নির্দিষ্ট করে বলাটা শক্ত। এর সাথে সাথে এটাও হলফ করে বলা যায় না যে যাঁরা একবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, ভবিষ্যতে তারা আর কখনও হবেন না৷
তবে এই রোগের সংক্রমণ আর লক্ষণ প্রকাশের মধ্যে প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের সময় বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড থাকে। এরপর দু-তিন দিন থাকে প্রোড্রোমাল সিম্পটমস বা পূর্বলক্ষণ৷ তবে অনেকের ক্ষেত্রেই আবার কোনোরকম পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই সরাসরি আক্রমণ করে হারপিস।
তবে খুব ছোটদের সাধারণত আক্রমণ করে না এই ভাইরাস৷
কিভাবে সংক্রমণ ছড়ায় এই ভাইরাস? শরীরের কোন কোন অংশ আক্রান্ত হয়?
বুকে, কোমরে, মুখে, কপালে, পিঠে — যে কোনো জায়গাতেই হতে পারে হারপিস। তবে প্রথমদিকে যে র্যাশ গুলি দেখা দেয়, সেগুলো একটু লালচে হয়। তার থেকেই কিছুক্ষণ পর ছোট ছোট ফুসকুড়ি দেখা দেয়। আর এই পুরো ব্যাপারটাই ঘটে মাত্র ৪ থেকে ১২ ঘন্টার মধ্যে। পরবর্তী দু’ তিন দিনের মধ্যে এরকম কয়েকটি ফুসকুড়ি থেকে ফোস্কা দল বেঁধে গজিয়ে ওঠে।
এটি সাধারণত শরীরের যেকোনো একটা দিকে, একটা বা দুটো নার্ভের এলাকা বরাবর হয় ।
সাধারণত দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায় হারপিস। সেভাবে কোনো জটিলতা দেখা না দিলে, কোনো দাগও আর থাকে না শরীরে। তবে ঘটতে পারে জীবাণুঘটিত সংক্রমণ। আক্রান্ত স্থানটি পেকেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দাগ দেখা দেয়।
তবে যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ কেবলমাত্র শরীরের একটি অংশে সীমাবদ্ধ না থেকে সারা দেহে ছড়িয়ে যেতে পারে। দেখা দিতে পারে রক্ত-ভরা ফোসকা।গুরুতর ক্ষেত্রে এর থেকে সেপ্টিসিমিয়া,এনকেফেলাইটিস, আর্থ্রাইটিস, নেফ্রাইটিস, নিউমোনিয়া,প্যানক্রিয়াটাইটিস এমনকী হেপাটাইটিসও হতে পারে।
তবে গর্ভাবস্থায় শেষের দিকে হারপিস হলে নবজাতকের সংক্রমণের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। আর গর্ভাবস্থায় প্রথম দিকে হলে শিশুটি নানারকমের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে পারে। একে বলে ‘কনজেনিটাল ভ্যারিসেলা সিনড্রোম’। আর একটি সমস্যা হতে পারে হারপিস থেকে, তা হলো পোস্ট-হারপেটিক নিউরালজিয়া (PHN)। হারপিস সেরে যাবার দু’মাস পর রোগীর এই PHN এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
তবে PHN এ আক্রান্ত হওয়ার ফলে যদি অপথ্যালমিক স্নায়ুটি আক্রান্ত হয়,তাহলে কেরাটাইটিস, আইরাইটিস, কর্নিয়ায় ঘা, এমনকী দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
হারপিস জোস্টার এর চিকিৎসা পদ্ধতি বা প্রতিকার কী?
• বিশ্রাম, এই রোগের মূল চিকিৎসাই হলো রোগীর সঠিক বিশ্রাম৷
• ব্যথার ওষুধ বা পেইনকিলার প্রয়োগ করা হয়, শরীরের প্রবল যন্ত্রণার থেকে মুক্তির জন্য।
• ভাইরাস সংক্রমণের প্রকোপ কমাতে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ করা হয়, ফলে অনেকক্ষেত্রেই উপশম হয় কষ্টের।
• অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ, বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় ওষুধের। অ্যাসাইক্লোভির বা ফ্যামসাইক্লোভির প্রয়োগ করা হয় সাধারণত।
তবে একটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন, তা হলো — এই রোগে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা অনুভব হয়। ফলে রোগী অনেকসময়ই বুঝে উঠতে পারেন না, তার আসলে কি হয়েছে৷ তাই এরকম কোনো উপসর্গ দেখা দিলে, তৎক্ষনাৎ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।