আজ কথা বলব হাই ব্লাড প্রেসার কমানোর ঘরোয়া উপায় নিয়ে। হাই ব্লাড প্রেশার বা হাইপারটেনশন কে “সাইলেন্ট কিলার” বা নীরব ঘাতকও বলা হয়। সাধারণত এর কোনো বড় রকমের লক্ষন থাকে না, তবে এর ফলে হার্টের নানা রোগ এবং স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ব্লাড প্রেশার কে মিলিমিটারস অফ মার্কারি– এই এককের মাধ্যমে মাপা হয়, যা mmHg দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
রক্তের চাপ নির্ভর করে হার্ট কতটা রক্ত পাম্প করতে পারছে এবং হার্ট ধমনীর ভেতর বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে স্বাভাবিক গতিতে কতটা যেতে পারছে তার ওপর। ধমনীর গতিপথ যত সরু হবে, ব্লাড প্রেশার তত বেশি হবে।
120/80 mm Hg এর কম যদি ব্লাড প্রেশার থাকে, তাহলে সেটা স্বাভাবিক। ব্লাড প্রেশার 130/80 mm Hg এর সমান বা বেশি হলে তাকে হাই ব্লাড প্রেশার বলা হয়। যদি ব্লাড প্রেশার 120/80 mm Hg এর বেশি এবং 130/80 mm Hg এর কম হয় তাহলে তাকে এলিভেটেড ব্লাড প্রেশার বলা হয়। এর অর্থ হাই ব্লাড প্রেশার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তবে একটা ভালো ব্যাপার হল এলিভেটেড ব্লাড প্রেশারের আওতায় থাকা মানুষজন নিজেদের জীবন যাত্রার কিছু পরিবর্তন করে ব্লাড প্রেশার কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, ওষুধ ছাড়াই। আসুন জেনে নি হাই ব্লাড প্রেসার কমানোর ঘরোয়া উপায়গুলি কি কি ?
১) এক্সারসাইজ এর মাধ্যমে
দেখা গেছে যারা নিয়মিত অ্যারোবিক এক্সারসাইজ অভ্যাস করেন তাঁরা 3.9 % সিস্টোলিক এবং 4.5 % ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেশার কে কম রাখতে পারে, যা অনেক ওষুধের কার্যক্ষমতার প্রায় সমান।
এক্সারসাইজের সময় হার্টের এবং শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়, ফলে ধীরে ধীরে হার্ট শক্তিশালী হয় এবং সহজেই রক্ত পাম্প করতে পারে। এর ফলে ধমনীর ওপর কম চাপ পরে এবং তা ব্লাড প্রেশার কে কম রাখতে সাহায্য করে। আমেরিকান কলেজ অফ কার্ডিওলজি (ACC) এবং আমেরিকান হার্ট অ্যাসোশিয়েসন (AHA) এর মতে প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন চল্লিশ মিনিট করে মাঝারি থেকে দ্রুত গতিতে এক্সারসাইজ করতে হবে। একসাথে ৪০ মিনিট এক্সারসাইজ করা অসুবিধা হলে সারাদিনে সময়টাকে ভাগ করে নিতে হবে।
২০১৭ সালের একটা পরীক্ষায় দেখা গেছে যে যাঁরা একেবারেই এক্সারসাইজ করেন না, তাঁদের তুলনায় কিছু মানুষ যাঁরা নিয়মিত তাই–চি (Shadowboxing) অভ্যাস করেছেন তাঁদের সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার 15.6 mm Hg কমেছে এবং ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেশার 10.7 mm Hg কমেছে। এরোবিক এক্সারসাইজ, রেসিস্টেন্স ট্রেনিং, হাই ইনটেনসিটি ইন্টারভাল এক্সারসাইজ অথবা প্রতিদিন ১০,০০০ পা হাঁটা, সবই ব্লাড প্রেশার কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
২)অতিরিক্ত ওজন কমানো
যদি কারোর অতিরিক্ত ওজন হয়, তাহলে অন্তত ৫ থেকে ১০ কেজি ওজন কমালেও ব্লাড প্রেশার কিছুটা কমে এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য রোগের সম্ভাবনাও কমে। ২০১৬ সালের একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য উপযোগী ডায়েটে গড়ে 3.2 mm Hg ডায়াস্টোলিক এবং 4.5 mm Hg সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার কে কমানো গেছে।
৩)চিনি এবং রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট বাদ দেওয়া
চিনি এবং রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট কে খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিলে একই সাথে ওজন এবং ব্লাড প্রেশার কে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে লো-কার্ব ডায়েট এবং লো-ফ্যাট ডায়েট উভয়ই ওজন কমাতে সাহায্য করে কিন্তু লোকার্ব ডায়েট বিশেষ করে ব্লাড প্রেশার কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। লোকার্ব ডায়েট 4.5 mm Hg ডায়াস্টোলিক এবং 5.9 mm Hg সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার কমাতে সাহায্য করে।
৪)খাদ্য তালিকায় পটাসিয়ামের পরিমান বাড়ানো এবং সোডিয়ামের পরিমান কমানো
খাদ্যে পটাসিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে লবন এর পরিমান কমিয়ে দিলে ব্লাড প্রেশার কে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। পটাসিয়াম রক্তে লবনের প্রভাব কে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রক্তজালিকার গতিপথ কে স্বাভাবিক রাখে। যদিও যাঁদের কিডনির অসুখ আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে পটাসিয়াম বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তাই খাদ্যে পরিবর্তন আনার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সাধারণ ভাবে যেসব খাদ্যে পটাসিয়াম বেশি পরিমানে থাকে সেগুলি হল —
- লো ফ্যাট যুক্ত দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন দুধ, দই ইত্যাদি
- মাছ
- কলা, অ্যাপ্রিকট, অ্যাভোক্যাডো, অরেঞ্জ
- আলু, মিস্টি আলু, টমেটো, পালংশাক ইত্যাদি
সাধারণ ভাবে ব্লাড প্রেশার কম রাখার জন্য উপযুক্ত খাদ্যতালিকা হল—
- লো সোডিয়াম ফুড
- ফল এবং সবজি
- কম ফ্যাটের দুগ্ধজাত খাদ্য
- দানাশস্য
- মাছ
- পোল্ট্রি
- বিনস
- মিস্টি ও রেড মিটের পরিমান কমানো
৫)প্রসেসড ফুড এড়িয়ে চলতে হবে
প্রসেসড ফুড এবং রেস্টুরেন্টের খাবারে লবনের পরিমান অতিরিক্ত থাকে। পিৎজা, চিপস, ক্যনড স্যুপ এবং অন্যান্য প্রসেসড ফুডে লবনের পরিমান অতিরিক্ত থাকে। যেসব খাবার “লো ফ্যাট” লেখা থাকে সেগুলোয় সাধারণত লবণ এবং চিনির পরিমান অতিরিক্ত থাকে যা ফ্যাট না থাকলেও স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। খাদ্য তালিকা থেকে প্রসেসেড ফুড কে সম্পূর্ণ ভাবে বাদ দিলে অতিরিক্ত চিনি, অতিরিক্ত লবণ ও রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট এর ইনটেক ও বন্ধ হয়ে যাবে।
৬)ধূমপান বন্ধ করা
ধূমপান বন্ধ করা স্বাস্থ্যের সামগ্রিক ভাবে উন্নতি করে। ধূমপান মূহুর্তের মধ্যে অস্থায়ী ভাবে ব্লাড প্রেশার এবং হৃদপিণ্ডের গতিবেগ বাড়িয়ে তোলে। দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান করলে তামাকের ভেতর থাকা রাসায়নিক রক্তজালিকার দেওয়াল কে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সেখানে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। ধমনীর গতিপথ সংকীর্ণ জয়ে ওঠে এবং এর ফলে রক্তের চাপ বেড়ে যায়।
তামাকের রাসায়নিক প্রভাব “প্যাসিভ স্মোকার” দেরও রক্তজালিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেসব পরিবারে বড়রা ধূমপান করে সেসব পরিবারে ছোটোদের খুব দ্রুত রক্তচাপ জনিত অসুখে ভোগার সম্ভাবনা থাকে।
৭)অতিরিক্ত স্ট্রেস কমানো
আমরা স্ট্রেসফুল জীবন কাটাই। কর্মক্ষেত্রে চাপ, পরিবারের প্রত্যাশা পূরণ, দেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি — সবই মানসিক চাপের কারন হয়ে দাঁড়ায়। রক্তচাপ কম রাখতে এবং শরীরের সামগ্রিক ভালো থাকা বজায় রাখতে স্ট্রেস কমানোর পদ্ধতি খুঁজে নিতে হবে। গান শোনা, হাঁটা, পছন্দের বই পড়া বা কমেডি দেখা ইত্যাদি করে মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দেখা গেছে গান শুনলে সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার এবং আকুপাংচার সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক উভয় ব্লাড প্রেশার কেই নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৮)যোগা এবং মেডিটেশন
যোগা এবং মেডিটেশনে উল্লেখযোগ্য ভাবে ব্লাড প্রেশার কম থাকে। যোগার ভেতর শ্বাস প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন শারীরিক ভঙ্গিমা এবং একাগ্রতার বা ধ্যানের অভ্যাস করা হয়। দেখা গেছে, যোগাভ্যাসকারি ব্যক্তিরা 3.62 mm Hg ডায়াস্টোলিক প্রেশার এবং 4.1 সিস্টোলিক প্রেশার কম রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
৯)ডার্ক চকোলেট
ডার্ক চকোলেট ব্লাড প্রেশার কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুবই সাহায্য করে। ডার্ক চকোলেটে উপ্সথিত কোকো, যার ভেতর ফ্ল্যাবোনয়েডস থাকে। এই ফ্ল্যাবোনয়েডস রক্তজালিকার গতিপথকে চওড়া রেখে ব্লাড প্রেশার কে কম রাখে। তাই দেখতে হবে যে ডার্ক চকোলেট এর ভেতর যেন অন্তত ৬০% থেকে ৭০% কোকো থাকে।
১০)কিছু ঔষধি গাছ–গাছড়া
কিছু কিছু ঔষধি গাছ ব্লাড প্রেশার কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুবই সাহায্য করে । এর ব্যবহার দীর্ঘ বহু বছর ধরে ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের গাছ–গাছড়াগুলি হল—
- ব্ল্যাক বিন (Castanospermum australe)
- ক্যাটস ক্ল (Uncaria rhynchophylla)
- সেলেরি জুস (Apium graveolens)
- চাইনিস হওথর্ন (Crataegus pinnatifida)
- আদা
- জায়ান্ট ডডার (Cuscuta reflexa)
- ইসবগুল (Blond psylliam)
- মেরিটাইম পাইন বার্ক (Pinus Pinaster)
- রিভার লিলি (Crinum glaucum)
- তিলের তেল (Sesamum indicum)
- টম্যাটো এক্সট্র্যাক্ট
- গ্রিন টি, ওলং টি
- আমব্রেলা টি বার্ক (Musanga cecropioides)
তবে এই ধরনের যেকোনো গাছ–গাছড়ার খাবার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
১১)গভীর ও ভালো রাতের ঘুম
রাতের ঘুমের সাথে ব্লাড প্রেশারের একটা ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্ক আছে। রাতের ঘুম যদি নিরবচ্ছিন্ন ও পর্যাপ্ত না হয় তাহলে ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়। ঘুমানোর সময় ব্লাড প্রেশার কম থাকে। দীর্ঘদিন ধরে যদি কোনো মানুষের রাতের ঘুম ৫ ঘন্টার কম হয়ে থাকে, তাহলে তার ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক ভাবেই বেশির দিকেই থাকবে।
১২) রসুনের ব্যবহার
একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে কাঁচা রসুন অথবা রসুনের সাপ্লিমেন্ট ব্লাড প্রেশার কম রাখে।
১৩) হাই প্রোটিন ডায়েট
একটি দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে যে যেসব ব্যক্তি উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করেন তাঁদের হাই ব্লাড প্রেশার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। প্রতিদিন যাঁরা মোটামুটি ১০০ গ্রাম প্রোটিন খাদ্য গ্রহন করেন, তাঁদের হাই ব্লাড প্রেশারের সম্ভাবনা ৪০% কম থাকে, যাঁরা লোপ্রোটিন খাদ্য গ্রহণ করেন তাঁদের থেকে। তবে যাঁদের কিডনির অসুখ আছে তাঁদের ক্ষেত্রে হাই প্রোটিন ডায়েট ক্ষতিকর হবে এবং খাদ্যাভ্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন আনার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
যেসব খাদ্যে উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ সেগুলি হল —
- মাছ
- ডিম
- মাংস
- ডাল ও দানা শস্য, যেমন — মুসুর ডাল, রাজমা, সয়বিন ইত্যাদি
- বাদাম বা বাদামের বাটার, যেমন — পিনাট বাটার
- মটরশুঁটি
- চিজ
এছাড়া খাদ্যতালিকায় ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যুক্ত খাবার রাখা, সোয়া প্রোটিন খাওয়া, মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ করা এবং ক্যাফিন জাতীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চরক্তচাপ কে নিয়ন্ত্রন করা যায়।