কোলেস্টেরল পরিমানে বেড়ে গেলে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়।যদিও কোলেস্টেরল কমানোর প্রাকৃতিক উপায়ও আছে কিন্তু তা অনেকেই জানেন না
ফ্যাটের মতই এটিও জলে দ্রবীভূত হয় না। লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল কে এবং অন্যান্য ফ্যাটে দ্রবীভূত ভিটামিনকে রক্তে বহন করে। বিভিন্ন ধরনের লাইপোপ্রোটিনের শরীরে বিভিন্ন প্রকারের কার্যকারিতা আছে। লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) যদি বেশি মাত্রায় শরীরে থাকে তাহলে রক্তজালিকার দেওয়ালে কোলেস্টেরল কে জমা করে যার ফলে ক্লগড আর্টারি, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনির সমস্যা দেখা দেয়।
কিন্তু হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (HDL) থাকলে তা কোলেস্টেরল কে বহন করে নিয়ে যেতে পারে এবং এই ধরনের অসুখকে রুখে দেয়।
কোলেস্টেরল কমানোর প্রাকৃতিক উপায়
আমরা এখন দশটি কোলেস্টেরল কমানোর প্রাকৃতিক উপায় সম্পর্কে আলোচনা করব, যার মাধ্যমে খারাপ কোলেস্টেরল LDL কে কমানোর এবং ভালো কোলেস্টেরল HDL কে বাড়ানোর প্রচেষ্টা করা যায়।
১. ট্রান্স ফ্যাট কে এড়িয়ে যাওয়া
ট্রান্স ফ্যাটও আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা হাইড্রোজেনেশন পদ্ধতির মাধ্যমে মডিফাই করা হয়। ভেজিটেবল অয়েলে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট কে স্থায়ী করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। মার্জারিন এই রকম একপ্রকার হাইড্রোজেনেটেড অয়েল দিয়েই তৈরি হয়। ট্রান্স ফ্যাট পুরোপুরি স্যাচুরেটেড নয় কিন্তু রুম টেম্পারেচারে জমাট বেঁধে থাকে, তাই প্যাস্ট্রি, কুকিজ ইত্যাদিতে এটা বেশি পরিমানে ব্যবহার করা হয়। আমাদের শরীরের জন্য এই আংশিক হাইড্রোজেনেটেড ট্রান্স ফ্যাট ক্ষতিকর এবং তা LDL এবং সামগ্রিক ভাবে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িতে দেয় এবং HDL এর পরিমান কমিয়ে দেয় ২০% পর্যন্ত।
যদিও বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটে “০ ট্রান্স ফ্যাট” লেখা থাকে, তবে কিছু পরিমাণে ট্রান্স ফ্যাট থেকেই যায়। তাই আমাদের উচিত খাবারের উপাদানগুলি লক্ষ্য করা। তাতে যদি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল থাকে তবে সেই খাবার বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়।
২. এক্সারসাইজ
এক্সারসাইজ সামগ্রিক ভাবে হার্টের সু-স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। নিয়মিত এক্সারসাইজ LDL কে কমিয়ে HDL কে বাড়াতে সাহায্য করে। হাঁটা, লাফানো, নানারকম অ্যারোবিক এক্সারসাইজ এবং তার সাথে ওয়েট ট্রেনিং ও রেসিস্টেন্ট ট্রেনিং সামগ্রিক ভাবে খুব ভালো ফল প্রদান করে। হাঁটার মতো লো-ইন্টেন্সিটি এক্সারসাইজ ও HDL এর বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
সপ্তাহে পাঁচদিন আধঘন্টা করে এক্সারসাইজ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে এবং হার্ট ডিজিজ কমাতে যথেষ্ট কার্যকরী। যেসব এক্সারসাইজে ৮৫% মতো হার্টরেট বৃদ্ধি পায় সেই ধরনের এক্সারসাইজ LDL কমে এবং উল্লেখযোগ্য ভাবে HDL বেড়ে যায়। রেসিস্টেন্ট এক্সারসাইজও একই রকম উপকার করে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে রিপিটেশন টা এক্সয় যত বেশি করা যাবে, তত টা কোলেস্টেরল কে নিয়ন্ত্রণ রাখার কাজে সাহায্য করবে।
৩. ওজন কম রাখা
আমরা কতটা কোলেস্টেরল গ্রহণ এবং শোষণ করবো তা স্মাদের খাদ্যাভ্যাসের ওপর নির্ভর করে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে একটা সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে যখন তাদের ওজন কমানোর জন্য উপযোগী খাদ্য দেওয়া হচ্ছিল, তখন তাদের শরীর খাদ্য থেকেই কোলেস্টেরল শোষণ করছিলো, আলাদা করে শরীরে কোলেস্টেরল তৈরি হচ্ছিলো না। এর ফলে LDL এর পরিমান না কমলেও HDL এর পরিমান বেড়েছিলো, ফলে হার্টের রোগের সম্ভাবনা কমে গিয়েছিলো।
৪. ধূমপান বন্ধ করা
ধূমপান আমাদের শরীরে অনেক প্রকার ক্ষতি করে এবং তা শরীরে কোলেস্টেরলের ওপরও প্রভাব ফেলে। ধূমপায়ীদের ইমিউনো সেল রক্তজালিকার দেওয়াল থেকে কোলেস্টেরল কে রক্তের মাধ্যমে যকৃৎ এ প্রেরণ করতে সক্ষম হয় না এবং এই সমস্যাটা টোব্যাকো টার এর সাথে ভীষণ ভাবে জড়িত। এই অকেজো ইমিউন সেলগুলো ধূমপায়ীদের ভেতর ক্লগড আর্টারির (ধমনীর গতিপথে বাধা) সৃষ্টি করে। ধূমপান বন্ধ করলে সামগ্রিক ভাবে কোলেস্টেরল এর মাত্রা কম থাকে।
কম রাখে, যদিও এক্ষেত্রে HDL বা LDL এর কনো পরিবর্তন দেখা যায় না। হার্ট ফেলিওর এর ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা হয়। যদিও এটি এখনও পরিস্কার নয় যে হার্ট ফেলিওর নাকি হার্ট অ্যাটাক কোনটার ক্ষেত্রে এটি বেশি উপযোগী।
কোলেস্টেরল কমানোর জন্য কি কি খাওয়া উচিত ?
কোলেস্টেরল কমাতে গেলে খাওয়া দাওয়ার ওপর আমাদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি মেনে চলতে পারলে সহজেই আপনি কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।
৫. মোনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটের প্রতি জোর দিতে হবে
আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটে ওয়ান ডবল কেমিক্যাল ব্যান্ড থাকে যেটা স্যাচুরেটেড ফ্যাটের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত এবং তা শরীরে অন্যরকম ভাবে কাজ করে। মোনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটে কেবল মাত্র একটা ডবল ব্যান্ড থাকে।
যদিও ওজন কমানোর জন্য লো–ফ্যাট ডায়েটের কথা বলা হয়, কিন্তু একটা পরীক্ষায় দেখা গেছে যে ৬ সপ্তাহের একটা লো–ফ্যাট ডায়েট পালন করে যেমন ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমেছে, তেমনি ভালো কোলেস্টেরল এর পরিমানও কমে গেছে। এর বিপরীতে মোনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটে সমৃদ্ধ ডায়েট যেমন ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কে কমায় তেমনি ভালো কোলেস্টেরল এর পরিমান বাড়াতে সাহায্য করে।
লাইপোপ্রোটিনের অক্সিডেশন হলে ক্লগড আর্টারির সমস্যা দেখা দেয় এবং মোনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট এই পদ্ধতিকে আটকে দেয়। সার্বিকভাবে মোনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তে খারাপ LDL কে কমিয়ে রাখে এবং ভালো কোলেস্টেরল, HDL বাড়িয়ে ক্ষতিকর অক্সিডেশন পদ্ধতিকে আটকে রাখতে পারে।
মোনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটের কিছু ভালো উৎস হল —
- জলপাই (অলিভ) এবং অলিভ অয়েল
- ক্যানোলা অয়েল
- আমন্ড, ওয়ালনাট, কাজু
- অ্যাভোক্যাডো
৬. পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, বিশেষত ওমেগা ৩
পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল LDL এর পরিমান কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে হার্টের সমস্যা কে কম রাখে। একটি সমীক্ষায় ১১৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর একটি পরীক্ষা করা হয়েছিলো, যেখানে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের বদলে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ডায়েটে দেওয়া হয়েছিলো। আট সপ্তাহ পরে দেখা গিয়েছিলো যে তাদের LDL এর মাত্রা ১০% কমে গিয়েছিলো। পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট মেটাবলিক সিনড্রোম এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস কেও নিয়ন্ত্রণ করে। ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এক ধরনের পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা হৃদপিণ্ডের জন্য খুব উপকারী। সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাবার এবং ফিস অয়েল সাপ্লিমেন্টে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়।
৭. খাদ্যে সলিউবল ফাইবার গ্রহণ
সলিউবল ফাইবার হল একপ্রকার উদ্ভিজ্জ পদার্থ যা জলে গুলে যায় এবং মানুষ এটা হজম করতে পারে না। কিন্তু আমাদের অন্ত্রে থাকা ভালো ব্যাকটেরিয়া এটা হজম করতে পারে এবং তাদের শরীরের পুষ্টির জন্য এটা প্রয়োজন হয়। এই ভালো ব্যাকটেরিয়া প্রোবায়োটিক নামে পরিচিত যারা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একটি সমীক্ষায় কিছু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের ১২ সপ্তাহের জন্য প্রতিদিন ৩ গ্রাম করে সলিউবল ফাইবার খাদ্যে দেওয়া হয়েছে এবং দেখা গেছে যে ১৮% LDL কম থেকেছে।
সলিউবল ফাইবারের কিছু উৎকৃষ্ট উৎস হল — বীনস, মটরশুঁটি, মুসুর ডাল,ফল, ওটস এবং দানাশস্য। ইসবগুলেও প্রচুর পরিমানে ফাইবার থাকে।
৮. প্লান্ট স্টেরলস এবং স্টানলস
প্লান্ট স্টেরলস এবং স্টানলস হল উদ্ভিজ্জ কোলেস্টেরল। কোলেস্টেরল জাতীয় খাদ্য থেকেই এগুলো শোষিত হয়।
এগুলো যেহেতু মানুষের দেহে উৎপন্ন কোলেস্টেরলের থেকে গঠনগত দিক দিয়ে আলাদা হয়, তাই তা ক্লগড আর্টারির সমস্যা (ধমনীর গতিপথে বাধা) তৈরি করে না এবং এর বিপরীতে মানুষ দেহে উৎপন্ন কোলেস্টেরলের সাথে প্রতিযোগিতা শুরু করে। এই স্টেরলস এবং স্টানলস শরীরে প্রবেশ করলে শরীর অন্য কোলেস্টেরল গ্রহণ করা বন্ধ করে দেয়। এর পরেও বলতে হবে এখনো এমন কোনো পরীক্ষা বা সমীক্ষার নির্দিষ্ট ফলাফল পাওয়া যায় না, যে সেখানে দেখা গেছে যে এটি হার্টের রোগ সারাতে সাহায্য করে।
৯. গ্রীন – টি
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন যদি গ্রীন-টি পান করা হয় তাহলে সেটি কোলেস্টেরল কমাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। সুস্থ থাকার জন্য প্রত্যহ অন্তত তিন কাপ করে গ্রীন-টি পান করুন এবং নিজের কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন।
১০. কিছু সাপ্লিমেন্ট
কিছু সাপ্লিমেন্ট কোলেস্টেরল কে নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে।
ফিস অয়েল — ফিস অয়েল ওমেগা—৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, docosahexaenoic acid (DHA) এবং eicosapentaenoic acid (EPA). এ সমৃদ্ধ। ৪২ জন মানুষের মধ্যে করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে যারা প্রতিদিন ৪ গ্রাম করে ফিস অয়েল সাপ্লিমেন্ট নিয়েছেন তাঁদের ফ্যাট রক্তের মাধ্যমে কম বহন হয়েছে। ফিস অয়েলের মাধ্যমে গ্রহণ করা ওমেগা —৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হার্টের রোগ ভীষণ নিয়ন্ত্রণ করে।
সিলিয়াম — এটি এক ধরনের সলিউবল ফাইবার যা সাপ্লিমেন্ট হিসেবে পাওয়া যায়। ৪ সপ্তাহে ৮ গ্রাম সিলিয়ামের ব্যবহার সমগ্র কোলেস্টেরলকে এবং LDL কে ১০% কম রাখতে সাহায্য করে।
Coenzyme Q10 — এটি এক প্রকারের ফুড কেমিক্যাল, যা কোশের এনার্জি তৈরিতে সাহায্য করে এবং খানিকটা ভিটামিন এর মতো কাজ করে। অনেক মানুষের মধ্যে অনেক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে Coenzyme Q10 সামগ্রিক ভাবে কোলেস্টেরলকে কম রাখে, যদিও এক্ষেত্রে HDL বা LDL এর কনো পরিবর্তন দেখা যায় না। হার্ট ফেলিওর এর ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা হয়। যদিও এটি এখনও পরিস্কার নয় যে হার্ট ফেলিওর নাকি হার্ট অ্যাটাক কোনটার ক্ষেত্রে এটি বেশি উপযোগী।