বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পায় ডিমেনশিয়ার মত ভুলে যাওয়ার রোগ । ডিমেনশিয়া রোগের কারণ , লক্ষণ ও প্রতিকার কী অধিকাংশ লোকেরাই তা জানেন না।নিম্নে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
বয়স প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই সুজিত বাবুর। পুত্রবধূর বারণ সত্ত্বেও বিকেলের হাঁটতে বেরোন এখনও। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বহুকালের পরিচিত অনেক মানুষকেই ইদানীং চিনতে পারছেন না তিনি, প্রথম দিকে অনেকেই ভেবেছিলেন আত্ম অহংকারে এড়িয়ে যাচ্ছেন সকলকে। কিন্তু দিনকয়েকের পর্যবেক্ষণে এটা পরিষ্কার হলো, স্মৃতিভ্রংশের ফলে তার এই আচরণ। জানা গেল বাড়িতেও আজকাল নিমেষের মধ্যে ভুলে যাচ্ছেন খানিক আগেই রাখা চশমা, জরুরি কাগজ এমনকি ওষুধও। ডাক্তারের কাছে চেক আপে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি জানান সুজিত বাবু ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। ডাক্তার এও জানালেন, এই অসুখটা সারে না ঠিকই। কিন্তু তাড়াতাড়ি ধরা পড়লে লাগাতার অবনতির সম্ভাবনায় অনেকটাই রাশ টানা যায়। কিন্তু মুশকিল হল, সচেতনতার অভাবে স্মৃতিভ্রংশ বা ডিমেনশিয়া অধিকাংশ বয়স্ক মানুষের যখন ধরা পড়ে, তখন তা আয়ত্তের বাইরে চলে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।
ডিমেনশিয়া আসলে কী?
ভুলে যাওয়া মানেই কিন্তু সবসময় স্মৃতিভ্রংশ নয়। কিন্তু সেই ভুলে যাওয়ার প্রবণতার মধ্যে যদি অস্বাভাবিক কিছু থাকে যেমন যে জিনিস যেখানে থাকা উচিত, সেখানে না রেখে অস্বাভাবিক কোনো স্থানে রাখা, তখন ডিমেনশিয়ার সন্দেহ সৃষ্টি হয়। ডিমেনশিয়া আসলে কোনো রোগ নয়, বরং বলা যায় কোনো নির্দিষ্ট রোগ বা আঘাতের শর্ত। ডিমেনশিয়া একধরণের ক্লিনিক্যাল উপসর্গ যেখানে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি বা জ্ঞানের কার্যকারিতা কমে যায়। এটি বুদ্ধি এবং ব্যবহারিক কার্যকারিতার বৈশিষ্ট্যকে কম করে যার ফলে দৈনন্দিন জীবন প্রভাবিত হয়। চার মিলিয়নের বেশি ভারতীয় ডিমেনশিয়ার কোনো না কোনো গঠনের দ্বারা আক্রান্ত। ডিমেনশিয়ার ফলে প্রভাবিত হয় আক্রান্ত ব্যক্তির স্মৃতি, চিন্তাশক্তি, ভাষার প্রয়োগ, বিচারবুদ্ধি, ব্যবহার ।
ডিমেনশিয়া রোগের কারণ ?
নানা কারণেই ডিমেনশিয়া হতে পারে। যেমন, মস্তিষ্কের কোনো রোগ বা আঘাত থেকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের এমন কিছু কোষ ও নার্ভ শুকিয়ে যায়, যার জেরে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্মৃতি ও চিন্তাভাবনা, যা দৈনন্দিন রুটিনকে মারাত্মক ব্যাহত করে। ফলত সৃষ্টি হয় ডিমেনশিয়া। এই ক্ষতি কখনই আচমকা হয় না। দীর্ঘ বছর ধরে খুব ধীরে ধীরে এই অসুখ থাবা বসায় মস্তিষ্কে। আর তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বেশি বয়সে। আর ক্রমাগত তার প্রভাব বাড়তেই থাকে আমৃত্যু।
এছাড়াও ডাক্তারদের মতে শরীরে ভিটামিন বা খনিজ উপাদানের ঘাটতি, মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা ইত্যাদি থেকেও দেখা যায় ডিমেনশিয়া। গবেষকদের মতে ওষুধের পাশাপাশি শরীরচর্চা ও মানসিক ব্যায়াম করে ডিমেনশিয়াকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়৷
ডিমেনশিয়ার লক্ষণ গুলি কী কী?
স্মৃতিশক্তি হ্রাস
স্মৃতিশক্তি ক্রমশ কমতে থাকা, বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিশক্তি হ্রাস এ রোগের প্রধান লক্ষন। স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ কোনো কথা ভুলে গেলেও কিছু ঘটনা বা নির্দিষ্ট কিছু বিষয় মনে রাখে। কিন্তু একজন ডিমেনশিয়ার রোগী তার বহুদিনের পরিচিত ব্যক্তিকে তার সম্বন্ধে জ্ঞাত সবকিছুই ভুলে যায়।
এমনকি ডিমেনশিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা দীর্ঘদিন যে বাড়িতে রয়েছেন তার ঠিকানা পর্যন্ত মনে রাখতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, ডিমেনশিয়া রোগী কখনও কখনও দিন না রাত,তাও মনে করতে পারেন না।
বিচারবুদ্ধি লোপ
ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির নিজের কার্যকলাপ সম্বন্ধে সব বোধ লোপ পায়৷ কোথায় কি পোষাক পরতে হবে, কোথায় কিভাবে চলতে হবে, বসতে হবে সেবিষয়ে বুদ্ধিবিভ্রাট ঘরে। যা করার তা না করে অদ্ভুত রকম কিছু করেন বা পরেন।
কর্ম বিভ্রাট
ডিমেনশিয়ার রোগীরা প্রায়ই দৈনন্দিন কাজে ক্লান্তি বোধ করেন।এমনও দেখা যায় একজন ডিমেনশিয়ার রোগী কীভাবে জামাকাপড় পরবেন,কীভাবে রান্না করবেন তাও ভুলে যান।
ভাষাপ্রয়োগে সমস্যা
কখনও কথা বলার সময় শব্দ মনে পড়ে না, এটা স্বাভাবিক ই ধরে নেয়া হয়। শুধু তাই নয় এই ধরনের রোগীরা প্রায়শই অতি সাধারণ কথাও মনে করতে পারেন না। আবার অসংলগ্ন ভাবে এমন সব কথা বলেন যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বোধগম্য হয়া না।
ডিমেনশিয়ার প্রকারভেদ গুলি কী কী?
মাইল্ড কগনিটিভ ডিমেনশিয়া
এই পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত কথা ভুলে যাওয়া, উপযুক্ত শব্দ মনে করে বলতে না পারা এবং সাময়িক স্মৃতিভ্রংশের সমস্যা দেখা যায়।
মাইল্ড ডিমেনশিয়া
এই পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।
মাইল্ড ডিমেনশিয়ার কয়েকটি লক্ষণ হলো –
সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ
রাগ বা হতাশা সহ ব্যক্তিত্বের কিছু পরিবর্তন
বিভ্রান্তি
মডারেট ডিমেনশিয়া
ডিমেনশিয়ার এই পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রিয়জন বা কাছে থাকা মানুষদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। এই সময় কিন্তু ডিমেনশিয়া প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
সিভিয়ার ডিমেনশিয়া
ডিমেনশিয়ার এই শেষ পর্যায়ে অবস্থার মানসিক এবং শারীরিক স্থিতি ক্রমাগত নষ্ট হতে থাকে। রোগীর শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়৷ এমনকি হাঁটতে বা খেতেও পারেনা৷ এই সময় রোগীর সর্বক্ষণের জন্য প্রিয়জনের সাহচর্য একান্ত প্রয়োজন৷
উপসর্গ ভিত্তিতে ডিমেনশিয়ার প্রকারভেদ গুলি কী কী?
রোগের ধরণ ও উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে ডিমেনশিয়ার কয়েকটি প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়।
১.অ্যালজাইমার্স
এই রোগটিই সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায় ডিমেনশিয়া আক্রান্তদের মধ্যে। মাত্র ৭-১০ বছর সময়ের মধ্যে এই রোগ একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে সম্পূর্ন রূপে গ্রাস করে ফেলে। মস্তিষ্কের যাবতীয় জ্ঞান আহরণ করার ক্ষমতা যেমন, বিচারবুদ্ধি, স্মৃতি, ভাষার প্রয়োগ, শব্দ উচ্চারণ বা কিছু মনে রাখার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
২. লিউই বডি ডিমেনশিয়া
আমাদের মস্তিষ্কে একধরনের অস্বাভাবিক প্রোটিনের পিণ্ড থাকে যা লিউই বডি (Lewy Body) নামে পরিচিত। এই ধরনের ডিমেনশিয়া রোগীর স্বপ্ন দেখার সময় দ্রুত চোখের পাতা কাঁপতে থাকে (Rapid Eye Movement)। এবং অনেকক্ষেত্রে স্বপ্নে দেখা জিনিস তিনি বাস্তবে করার চেষ্টা করেন।
৩. ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া
এই ধরনের ডিমেনশিয়া অপেক্ষাকৃত কম বয়সে হয়। অর্থাৎ ৪০-৬৫ বছর বয়সের মধ্যে আঘাত হানে। এর ফলে আমাদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল ও টেম্পোরাল লোবের স্নায়ুকোষ গুলির ক্ষয় হতে থাকে। এই ফ্রন্টাল লোব ও টেম্পোরাল লোবের কাজ হল আমাদের ব্যাক্তিত্ব, ব্যবহার ও ভাষাজ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করা। এর ফলে ব্যক্তির চিন্তাভাবনা থেকে শুরু করে হাঁটাচলা পর্যন্ত বিপর্যস্ত হতে থাকে।
৪. সংবহনতান্ত্রিক ডিমেনশিয়া
এক্ষেত্রে স্ট্রোক, হৃৎপিণ্ডের ভালভে সংক্রমণ বা অন্যান্য কারণে রক্ত চলাচল ব্যাহত হবার জন্য মস্তিষ্কে কোষের ক্ষয় হতে দেখা যায়।
কিভাবে নির্ণয় ধরা হয় ডিমেনশিয়া?
ডিমেনশিয়া নির্ণয়ের জন্য রোগীর মেডিকেল হিষ্ট্রি এবং শারীরিক পরীক্ষার প্রয়োজন। ডাক্তারের সাথে পরামর্শের সময় বুদ্ধির কার্যকারিতার মূল্যায়ন করা হয়৷ এছাড়াও অতিরিক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
মিনি-মেন্টাল স্টেট এক্সামিনেশন (এমএমএসই) হল বুদ্ধির কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত পরীক্ষা। প্রয়োজন হলে আরও কয়েকটি পরীক্ষার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। যেমনঃ
রক্ত পরীক্ষা।
মস্তিষ্কের এমআরআই বা সিটি স্ক্যান।
ইইজি।
ডিমেনশিয়া রোগের প্রতিকার বা চিকিৎসা
সাধারণত দু’ধরণের চিকিৎসাই প্রাথমিক ভাবে করা হয়। তা হলো ওষুধের প্রয়োগ এবং নন-ড্রাগ থেরাপি।
ওষুধের দ্বারা ডিমেনশিয়ার চিকিৎসা খুব সামান্যই কার্যকরী হয়। কেমিক্যাল গুলির বৃদ্ধির জন্য ওষুধের পরামর্শ দেওয়া হয়, এর ফলে স্নায়ুতে সংকেত পৌঁছাতে পারে। তবে শুধুমাত্র ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক থেকে মধ্যম পর্যায়ের ক্ষেত্রেই কার্যকর হতে দেখা গেছে।
সাধারণত দু ধরনের ওষুধই প্রয়োগ করা হয়।
Cholinesterase Inhibitors
এই ওষুধগুলি এসিটাইলকোলিন নামে একটি রাসায়নিকের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এই রাসায়নিক স্মৃতির গঠনে এবং মস্তিষ্কের বার্তাকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এর প্রয়োগে ডিমেনশিয়ার লক্ষণ প্রকাশকে বিলম্বিত করে।
Memantine
এই ওষুধটি মডারেট বা সিভিয়ার ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের জ্ঞান এবং আচরণগত সমস্যাকে বিলম্বিত করে। । এটি ডিমেনশিয়ার রোগীদের দীর্ঘ সময়ের জন্য স্বাভাবিক মানসিক ক্রিয়াকলাপ বজায় রাখতে সাহায্য করে৷
নন–ড্রাগ থেরাপি
এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওষুধের থেকেও বেশি কার্যকর হয়। সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা, অতিরিক্ত ভিড়, চিৎকার, উত্তেজনা এড়িয়ে চলা, একজন থেরাপিস্টের সাহায্যে রোজকার টাস্ক করানো এবং গ্রুমিং ডিমেনশিয়ার চিকিৎসায় ভালো ফল দেয়। অকুপেশনাল থেরাপিও ডিমেনশিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
এই রোগের প্রতিরোধ কিভাবে সম্ভব?
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ করতে ডাক্তাররা কিছু পরামর্শ দেন। যেমনঃ
বিভিন্ন রকম কাজে মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখা ভালো। সারা দিনের গতানুগতিক কাজের পর অবসরে বই পড়া, ভালো গান শোনা, রিল্যাক্সিং মিউজিক শোনা, মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে ভালো ভাবে কাজ করতে পারে এমন কিছু খেলা, দাবা খেলা, অন্যান্য বুদ্ধির খেলা এবং যেকোনো সৃজনশীল কাজের নিয়মিত চর্চা স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্যকর খাবার খেতেই হবে৷ অতিরিক্ত ফ্যাট জাতীয় ফাস্ট ফুড বা প্রসেসড খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। বেশি করে তাজা শাকসবজি ও ফলমূল নিয়মিত খেতে হবে৷ নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রয়োজন প্রোটিনও। প্রয়োজনে ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিতে হবে৷
ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করুন। বয়স ষাট পেরোলে তো একেবারেই নয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিশ্রাম ও পর্যাপ্ত ঘুম মস্তিষ্কের ‘সেভিং মোড’-এর জন্য একান্ত প্রয়োজন।
রক্তচাপ, রক্তের শর্করা ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এগুলো মস্তিষ্কের ক্ষয় ও রক্ত চলাচল কমিয়ে দেওয়ার জন্য ভীষণ ভাবে দায়ী। নিয়মিত হাঁটুন, এবং শারীরিক সমস্যা না থাকলে প্রতিদিন ২০ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ ভীষণ ভাবে কার্যকরী।
সবসময় সামাজিক থাকুন। অন্যদের খোঁজখবর রাখুন, নানা রকম সামাজিক কাজে নিজেকে যুক্ত করুন। বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে সময় কাটান। পরিবারকে সময় দিন।