ঘুম অলসতার লক্ষণ নয়। ঘুমের উপকারিতা অপরিসীম। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়, বার্ধক্য সমস্ত বয়সের জন্যই নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুমের দরকার হয়। গর্ভাবস্থায় নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুম গর্ভস্থ শিশুকে সুস্থ রাখে। ভালো স্বাস্থ্যকর খাবার অথবা ব্যায়ামের মতনই রাতের ভালো ঘুম স্বাস্থ্যের পক্ষে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
কোন বয়সে কতটা ঘুমের দরকার তার কি কোনো নির্দিষ্ট তালিকা আছে ?
সঠিক বয়সে সঠিক পরিমান ঘুম প্রয়োজন। আর বয়স অনুযায়ী কার কতটা ঘুমের দরকার তার সাধারণত একটা পরিমাপও আছে এবং সবারই তা জানা উচিৎ –
- সদ্যজাত অবস্থা থেকে প্রথম তিন মাস প্রতিদিন ১৪ – ১৭ ঘন্টা ।
- চার থেকে এগারো মাস বয়সের শিশুদের দৈনিক ১২ – ১৫ ঘন্টা ।
- এক থেকে দুই বছর বয়সের মধ্যে শিশুদের কমপক্ষে ১১ ঘন্টা ।
- সদ্য স্কুল যাওয়া শুরু হলে অর্থাৎ তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সে রোজ নূন্যতম ১০ ঘন্টা ।
- ছয় থেকে বারো অর্থাৎ টিনেজ অবস্থা আসার আগে দৈনিক ৯ – ১১ ঘন্টা ।
- টিনেজ অবস্থায় অর্থাৎ তেরো থেকে আঠারো বছর বয়সের মধ্যে রোজ ৮ থেকে ১০ ঘন্টা ।
- প্রাপ্ত বয়স্কদের ঘুম সাধারণত দৈনিক ৭ – ৯ ঘন্টা, তবে কারো ৬ ঘন্টা আবার কারো দশ ঘন্টাও ঘুমের দরকার হয়।
- পঁয়ষট্টি বছর বয়সের পর এক জন মানুষের রোজ ৭ -৮ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন।
বয়সের পাশাপাশি কতগুলি বিষয় আছে যা আপনার ঘুম কে প্রভাবিত করতে পারে, যেমন-
প্রেগ্ন্যান্সি– এই সময় নারী শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, ফলে এদের ঘুমের পরিমাণ বাড়তে পারে।
পূর্ববর্তী ঘুমজনিত সমস্যা– পূর্ববর্তী সময়ে দীর্ঘদিন কম ঘুমানো বা রাতে ঘুমের সমস্যা থাকলে পরবর্তী কালে ঘুমের পরিমাণ বাড়তে পারে।
ঘুমানোর মান– ঘুমানোর পরিমাণের পাশাপাশি ঘুমানোর মানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রাতে ঘুমানোর সময় যদি বারংবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে তাহলেও ঘুমানোর সময় স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে যায়।
ঘুমের উপকারিতা কতখানি ? পরিমাণ মত ঘুম না হলে কি কি সমস্যা দেখা দিতে পারে ?
বিশেষজ্ঞদের মতে সকালে যদি সুস্থ শরীরেও কোন রকম আচ্ছন্ন বোধ দেখা দেয়, এমনকি তা কোনো রকম সাধারণ কাজ হলেও, তাহলে বুঝতে হবে যে, সঠিক পরিমাণ ঘুম হচ্ছে না। সুস্থ শরীরেও যদি পরিমান মত ঘুম না হয় তাহলে সাধারণত নিম্নলিখিত সমস্যা গুলো দেখা দেয় –
- সকালে উঠেও তন্দ্রাছন্ন ভাব। বিশেষ করে শান্ত অবস্থায় মুভি দেখা বা গাড়ি চালানোর সময়।
- বিছানায় শুলেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়া।
- মাইক্রোস্লিপ। জেগে থাকতে থাকতেই হঠাৎ ঘুমিয়ে নেওয়া।
- প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার জন্য এল্যার্মের প্রয়োজন হওয়া।
- স্লিপ ইনারসিয়া। ঘুম থেকে ওঠার পরে অথবা তারপর সারাদিন ধরে হালকা নেশাগ্রস্থ অবস্থার মত অনুভূতি।
- রোজ ঘুম থেকে ওঠার সময় অস্বস্তি।
- মেজাজ পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।
- ভুলে যাওয়া।
- কাজে মনোযোগ ব্যহত হওয়া।
- কাজের সূত্রে সকালে না উঠলে দীর্ঘক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে থাকা।
ঠিকঠাক পরিমাণ মত ঘুম না হলে এই ধরণের কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বেশিভাগ সময়ে এ জাতীয় সমস্যা কমবেশি সকলেরই হয়ে থাকে। আর সেটা পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার কারণেই। অতএব বোঝাই যাচ্ছে একজন মানুষের স্বাস্থ্যকর ঘুমের প্রয়োজন কতখানি।
দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে, তা থেকে কি অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে ?
দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে বা কিছু দিন অন্তর যদি পর্যাপ্ত ঘুম বারবার বাধা প্রাপ্ত হয় তবে আরো একাধিক কঠিন সমস্যা দেখা দিতে পারে। অল্প পরিমাণ ঘুম বা ঘুমের ঘাটতির কারণে যে ধরণের সমস্যা দেখা দেয়, তা হল –
- স্মৃতিশক্তি জনিত সমস্যা।
- মানসিক ডিপ্রেশন।
- মোটিভেশনের অভাব অনুভব করা।
- সামান্য কারণে রেগে যাওয়া বা ইরিটেশন।
- কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া
- শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার হ্রাস এবং অসুস্থতার সম্ভবনা বৃদ্ধি।
- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, হার্ট এট্যাক এর সম্ভবনা বৃদ্ধি।
- যৌন ক্ষমতার ঘাটতি।
- চামড়ায় ভাঁজ, চোখের নিচে কালি, ত্বকে বয়সের ছাপ বৃদ্ধি।
- অতিরিক্ত ক্ষিদে এবং শরীরের ওজন বৃদ্ধি।
- সমস্যা সমাধানে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসুবিধা।
- হ্যালুসিনেশন।
পরিমাণ মত ঘুম না হলে তা ধীরে ধীরে চরম মানসিক এবং শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময়য় নেশার কারণে ঘুম কমে যায়। পাশাপাশি ক্লান্ত অবস্থায় মদ্যপান করে ঘুম বা ঘুমানোর চেষ্টা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।
তালিকা অনুযায়ী পরিমাণ মত ঘুম না হলে কিম্বা উল্লিখিত কোন ধরণের এক বা একাধিক সমস্যা টানা দেখা দিলে অথবা এধরণের সমস্যা বারবার দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিজে থেকে কোনো রকম ঘুমের ওষুধ বা এন্টি-ডিপ্রেশন পিল কখনই নেওয়া উচিৎ নয়। তাতে হিতে বিপরীত হবে।
স্বাস্থ্যকর ঘুমের দরকার? কি করবেন?
১। ঘুমের একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন এবং সেটি মেনে চলার চেষ্টা করুন।
২। রাতে চা-কফি বা অন্য কোনও রকম উত্তেজক পানীয় থেকে বিরত থাকুন। এমনকি কি খাবারে পর জলের পরিমাণও সীমিত রাখুন। রাতে অধিক পানীয় গ্রহণ করলে বার-বার প্রসাবে যাওয়ার কারণে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
৩। ঘুমানোর সময় মোবাইল বা টিভি থেকে দুরে থাকুন। বিছানায় মোবাইল নিয়ে ঘুমানো একটি অস্বাস্থ্যকর অভ্যেস।
৪। যদি আপনি দিনে ঘুমান তাহলে সেটি বন্ধ করুন বা কমিয়ে আনুন।
৫। চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন, আপানরা অতিরিক্ত চিন্তা আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর পাশাপাশি উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতন সমস্যাগুলি ডেকে আনতে পারে।