ইনসুলিন কী?
ইনসুলিন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমোন । সাধারণভাবে মানবশরীরে এই হরমোন প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের বিটা সেল থেকে তৈরি হয় এবং রক্তে মেশে।
ইনসুলিনের কাজ কী?
i.এই হরমোন রক্ত থেকে গ্লুকোজকে মাংসপেশি, লিভার ও চর্বিকোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
ii. এই হরমোন দেহের প্রোটিনকে ভেঙে যাওয়া থেকে আটকায়।
কোনও কারণে যদি দেহে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি না হয় বা ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে তাহলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই রোগে পেশি বা চর্বিকোষে গ্লুকোজ ঢুকতে পারে না। ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায় । যদি সুগার সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা যায় দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হতে থাকে। ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসায় তাই নানা সময়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি ইনসুলিন নেওয়ার দরকার পড়ে।
ইনসুলিন কখন নিতে হয় ?
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য জীবনদায়ী একটি ওষুধ হল ইনসুলিন। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের হয়—
i.টাইপ-১ ডায়াবেটিস।
ii. টাইপ-২ ডায়াবেটিস।
তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ গর্ভাবস্থায়ডায়াবেটিস বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস নামক এক প্রকার ডায়াবেটিসের উল্লেখ করেছেন।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের একমাত্র চিকিৎসা হল কৃত্রিম ইনসুলিন নেওয়া। খুব কম বয়সে এই রোগ ধরা পড়ে বলে এই ডায়াবেটিসকে জুভেনাইল ডায়াবেটিস বলা হয়। টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীর ইনসুলিন উৎপাদনের জন্য দায়ী বিটা সেল অনুপস্থিত থাকে। তাই টাইপ-১ ডায়াবেটিসে কৃত্রিম ইনসুলিন নেওয়া ছাড়া অন্য কোনওভাবেই চিকিৎসা সম্ভব নয়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসে রোগী আক্রান্ত হন একটু বেশি বয়সে। মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশই হল টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগী। এই সমস্যায় প্রথমদিকে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ আনতে বা দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিসের রোগীকে একসময় ইনসুলিন দিয়েই চিকিৎসা করতে হয়। আবার ওষুধ এবং ইনসুলিন দু’টিই একসঙ্গে চলতে পারে প্রয়োজন অনুসারে।
জেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে একমাত্র ওষুধ হল কৃত্রিমভাবে ইঞ্জেকশনের সাহায্যে ইনসুলিন নেওয়া। তবে সন্তানের জন্মের পরেই সন্তানসম্ভবা মায়ের ডায়াবেটিসের সমস্যা চলে যায়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসে কখন ইনসুলিন?
সাধারণ মানুষের ধারণা, অসুখের শেষ পর্যায়ে প্রয়োগ করা হয় ইনসুলিন। অনেকে আবার ভাবেন একবার ইনসুলিন চালু হলে তা আর বন্ধ করার উপায় থাকে না। এই ধারণা একেবারেই সত্যি নয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসে একবার ইনসুলিন নিতে হলে তার অর্থ এই নয় যে রোগীকে সারাজীবনই ইনসুলিন নিয়ে যেতে হবে। রোগীকে ইনসুলিন নিতে হবে নাকি কি হবে না তা নির্ভর রোগীর অসুখের অবস্থার উপর।
কতকগুলি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস খুব ধীরে ধীরে শরীরে থাবা বসায়। রোগী অনেক সময় লক্ষণগুলি বুঝতেও পারেন না। অনেকক্ষেত্রেই এমন হয় যে রোগী অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করেন ও চিকিৎসকের কাছে আসেন। চিকিৎসক তখন তাঁকে ব্লাড সুগার টেস্ট করাতে দেন ও দেখা যায় ওই ব্যক্তির ব্লাড সুগার স্বাভাবিকের থেকে কয়েকগুণ বেশি! এমন ক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে ১ থেকে ২ মাস রোগীকে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে চিকিৎসক এরপর ইনসুলিন বন্ধ করে রোগীকে মুখে খাওয়ার ওষুধ দিতে পারেন।
একজন ব্যক্তির ছানি বা হার্নিয়ার মতো সার্জারি করার প্রয়োজন। এদিকে রোগীর ব্লাড সুগার হাই। এমন অবস্থাতে রোগীর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকদিন ইনসুলিন ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসক। অপারেশনের পর প্রয়োজন বুঝে ইনসুলিন বন্ধ করে ফের খাওয়ার ওষুধ খেতে পারেন রোগী।
কোনও ডায়াবেটিস রোগীর নিউমোনিয়া বা হঠাৎ গুরুতর কোনও সংক্রমণ হলে সাময়িকভাবে তাকে ইনসুলিন নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন চিকিৎসক। অন্যদিকে কোনও রোগীকে হয়তো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে একাধিক ওষুধ খেতে হচ্ছে, অথচ সুগার কোনওভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না এমন ক্ষেত্রেও রোগীকে ইনুসলিন নিতে হতে পারে। এমনকী কিছু ক্ষেত্রে সারাজীবনও ইনসুলিন নেওয়ার দরকার পড়তে পারে।
ওষুধের থেকে কি ইনসুলিন ভালো?
ডায়াবেটিসের মূল চিকিৎসা হল রক্তের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। সুগারের সঙ্গে যদি হাই ব্লাড প্রেশার, হাই ব্লাড কোলেস্টেরল থাকে তাহলে সেই ধরনের সমস্যাও নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। যত ভালোভাবে এবং বেশিদিন এই সকল সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে ততই ডায়াবেটিস সংক্রান্ত অন্যান্য শারীরিক জটিলতা এড়ানো যায়। এর জন্য প্রয়োজন পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা এবং প্রয়োজন মতো সুগারের ওষুধ বা ইনসুলিন নেওয়া। ব্লাড প্রেশার ও কোলেস্টেরলের সমস্যার জন্য ওষুধ খেতে হবে। অর্থাৎ, যেভাবেই হোক সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
রোগীর রক্তের ব্লাড সুগারের মাত্রা এবং তার শারীরিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে ওষুধ ভালো নাকি ইনসুলিন ভালো ।
অর্থাৎ, ওষুধ ও ইনসুলিন কখনোই কোনোটির বিকল্প নয়। একে অপরের পরিপূরক।