ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড হল ছোট ছোট টিউমার আকৃতির মাংস পিণ্ড যা জরায়ুর দেওয়ালে তৈরি হয়। এই টিউমারগুলো “বিনাইন” প্রকৃতির, অর্থাৎ নন ক্যান্সারাস। যদিও এগুলোর ফলে যন্ত্রণা ও অন্যান্য রোগলক্ষণ দেখা যায়। মহিলাদের শরীরে যত রকমের বিনাইন টিউমার হয়, তার ভেতর ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। বেশিরভাগ মহিলাদের তাদের সন্তান ধারনের উপযুক্ত বয়সের ভেতর এর অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, আবার কারও কারও ক্ষেত্রে মেনোপজের সময়েই প্রথম ফাইব্রয়েড রোগের লক্ষণ দেখা যায়।
ফাইব্রয়েড এবং হরমোন
ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন ফাইব্রয়েডের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। মেনোপজের সময় ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোনের উৎপাদন কমে যায়, ফলে ফাইব্রয়েড হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। হরমোনের হঠাৎ কমে যাওয়ার আগে থেকে যে ফাইব্রয়েড গুলো আছে, তাদের আকারও ছোট করে দেয়।
ফাইব্রয়েডের রিস্ক ফ্যাক্টর
কিছু কিছু শারীরিক পরিস্থিতির কারণে ফাইব্রয়েড হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সেগুলো হল —
- হাই ব্লাড প্রেশার
- ভিটামিন ডি শরীরে কম থাকা
- পরিবারের মহিলাদের ফাইব্রয়েড হয়ে থাকলে (ফ্যামিলি হিস্ট্রি)
- ওবেসিটি
- কখনো প্রেগন্যান্ট না হয়ে থাকলে
- দীর্ঘদিন ধরে প্রচন্ড মানসিক চাপ
ফাইব্রয়েড রোগের লক্ষণ
মেনোপজের আগে ও পরে ফাইব্রয়েডের রোগ লক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণ ভাবে মেনোপজের আগে রোগলক্ষণ অনেক বেশি সমস্যা-দায়ক হয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো ফাইব্রয়েডের একেবারেই কোনো রোগলক্ষণ থাকে না। মেনোপজের আগে হোক বা পরে, সাধারণ ভাবে যে রোগলক্ষণগুলো দেখা যায়, সেগুলো হল —
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত
- প্রায়ই স্পটিং হওয়া
- অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে অ্যানিমিয়া
- প্রায়ই মেনস্ট্রুয়াল ক্রাম্পিং এর মতো যন্ত্রণা হওয়া
- তলপেট ভারী হয়ে থাকা
- পেটে ফোলাভাব ও ব্যাথা
- পিঠের নীচের দিকে যন্ত্রণা হওয়া
- বারবার মূত্রত্যাগের প্রবণতা
- যন্ত্রণাময় সঙ্গম
- জ্বর
- গা গুলানো
- মাথা যন্ত্রণা
মেনোপজের পরে ফাইব্রয়েডের চিকিৎসা
ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করতে গেলে বর্তমানে জন্ম নিরোধক বড়ি (বার্থ কন্ট্রোল পিল) সবথেকে বেশি ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসক সার্জারীর মাধ্যমেও ফাইব্রয়েড অপসারনের কথা বলতে পারেন, যাকে “মায়োমেকটমি” বলা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিসটেরেক্টমি বা সার্জারীর মাধ্যমে সম্পূর্ণ জরায়ু বাদ দেওয়ারও প্রয়োজন পড়তে পারে।
হরমোন থেরাপি
বার্থ কন্ট্রোল পিলের সাহায্যে অতিরিক্ত রক্তপাত ও যন্ত্রণা কে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদিও এতে ফাইব্রয়েডের আকার ছোট হয় না বা তারা সেরে যায় না। ফাইব্রয়েড নিয়ন্ত্রণে কম্বিনেশন অথবা শুধুমাত্র প্রোজেস্টিন আছে এমন বার্থ কন্ট্রোল পিল ব্যবহার করা হয়। প্রোজেস্টিন মেনোপজের অন্যান্য সমস্যাকেও কম রাখে এবং হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি কে ভালো ভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।
যন্ত্রণা ও অতিরিক্ত রক্তপাত কমানোর জন্য অন্যান্য যে হরমোনাল ট্রিটমেন্ট করা হয়, তা হল প্রোজেস্টিন ইঞ্জেকশন এবং ইন্ট্রাইউটেরাইন ডিভাইস, যাতে প্রোজেস্টিন থাকে।
মায়োমেকটমি
মায়োমেকটমি ফাইব্রয়েড এবং তার অন্যান্য রোগ লক্ষণ যেমন অতিরিক্ত রক্তপাত ইত্যাদিকে বন্ধ করে দেয়। এই সার্জারী তখন করা হয়, যখন রোগী ভবিষ্যতে সন্তান ধারন করতে চান বা অন্য কোনো কারণে তাঁর জরায়ুর প্রয়োজন হতে পারে এমন ক্ষেত্রে।
৮০% থেকে ৯০% মহিলাই মায়োমেকটমির মাধ্যমে রোগলক্ষণ থেকে মুক্তি পায় বা তাদের রোগলক্ষণ কমে যায়। বাদ দেওয়া ফাইব্রয়েডগুলো সার্জারীর পরে আর ফিরে আসে না, তবে আবার নতুন ফাইব্রয়েড তৈরি হতে পারে। এই সার্জারি করা ৩৩% মহিলার পাঁচ বছরের ভেতর আবার সার্জারী করার প্রয়োজন হয়েছে, কারন ইউটেরাসে তাদের নতুন ফাইব্রয়েডের জন্ম হয়েছে।
এই সার্জারি তিনটি পদ্ধতির ভেতর যেকোনো একটি ভাবে করা হয়, এবং কোন পদ্ধতিতে হবে, তা নির্ভর করে ফাইব্রয়েডের সংখ্যা, আকার ও অবস্থানের ওপর। এই ক্ষেত্রে জেনারেল অ্যানাস্থেসিয়া করা হয়। মায়োমেকটমি বিভিন্ন ভাবে করা হয় এবং এটা নির্ভর করে ফাইব্রয়েডের অবস্থানের ওপর।
যদি ফাইব্রয়েড ইউটেরাইন ক্যাভিটির ভেতর হয়, তাহলে সার্জারী হিস্টেরেস্কোপির মাধ্যমে একটি সরু, লম্বা এবং আলো লাগানো টিউবের সাহায্যে করা হয়।
কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক তলপেটে কিছুটা চিরে এই সার্জারী করেন।এই ধরনের সার্জারীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
ছোট আকৃতির ফাইব্রয়েড থাকলে ল্যাপ্রোস্কোপির মাধ্যমে সার্জারী করা হয়। এতে সুস্থতা অনেক দ্রুত হয়।
হিসটেরেক্টমি
হিসটেরেক্টমিতে জরায়ুর কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ জরায়ু টাই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। রোগীর যদি সংখ্যায় অনেক, আকারে বড় ফাইব্রয়েড থাকে এবং রোগীর যদি ভবিষ্যতে সন্তান ধারনের কোনো পরিকল্পনা না থাকে তাহলে এই সার্জারী করা হয়। সার্জেন কয়েকটি পদ্ধতিতে জরায়ু কে বাদ দিতে পারেনঃ
ল্যাপারোটমি অথবা অ্যাবডোমিনাল হিসটেরেক্টমি
সার্জেন সার্জারীর মাধ্যমে তলপেট কেটে জরায়ু বাদ দিয়ে দেন।
ভ্যাজাইনাল হিসটেরেক্টমি
সার্জেন রোগীর যোনিপথের মাধ্যমে জরায়ু বাদ দেন, তবে অনেক বড় ফাইব্রয়েড এর ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে কাজ হয় না।
ল্যাপরোস্কোপিক হিসটেরেক্টমি
এই পদ্ধতিতে সার্জেন কিছু ইনস্ট্রুমেন্টস প্রবেশ করিয়ে জরায়ুকে ছোট ছোট টুকরো তে কেটে বের করে আনেন।
সার্জেন রোগীর ডিম্বাশয় এবং সার্ভিক্সকে অক্ষত রাখেন, ফলে রোগী আবার ফিমেল হরমোন তৈরি করতে পারেন। অ্যাবডোমিনাল হিসটেরেক্টমিতে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। ল্যাপরোস্কোপি হিসটেরেক্টমি এবং ভ্যাজাইনাল হিসটেরেক্টমিতে সুস্থতা অনেক দ্রুত আসে।
হিসটেরেক্টমি যে যে ক্ষেত্রে নির্ধারণ করা হয়, সেগুলো হল —
- যাঁরা মেনোপজের খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন
- যাঁদের মেনোপজ হয়ে গেছে
- সংখ্যায় অনেক ফাইব্রয়েড আছে
- ফাইব্রয়েডের আকৃতি অনেক বড়
- ভবিষ্যতে সন্তান ধারনের ইচ্ছা/সম্ভাবনা নেই
- অন্যান্য সব থেরাপি করার পরও ফাইব্রয়েড ফিরে এসেছে
অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি
মেনোপজ চলছে বা মেনোপজ পরবর্তী সময়ের মহিলাদের জন্য মিনিমাল ইনভেসিভ (সামান্য কাটা ছেঁড়া) অথবা নন ইনভেসিভ (কোনো কাটা ছেঁড়া নেই) আরও নানা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। সেগুলো হল —
মায়োলাইসিস
ফাইব্রয়েড ও তার সাথে সংযুক্ত রক্তজালিকাকে উত্তাপ বা ইলেকট্রনিক কারেন্টের মাধ্যমে নষ্ট করে দেওয়া হয়।
ফোর্সড আল্ট্রা সাউণ্ড সার্জারী
হাই এনার্জি, হাই ফ্রিকোয়েন্সি সাউণ্ড ওয়েভ পাঠিয়ে ফাইব্রয়েড নষ্ট করে দেওয়া হয়।
এন্ডোমেট্রিয়াল অ্যাবলেশান
উত্তাপ, ইলেকট্রিক কারেন্ট, গরম জল বা অতিরিক্ত ঠান্ডা ব্যবহার করে ইউটেরাইন লাইনিং কেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
ইউটেরাইন আর্টারি এমবোলাইজেশন
এর মাধ্যমে ফাইব্রয়েডে রক্ত সঞ্চালন ও রক্ত পরিবহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সাধারণ ভাবে ফাইব্রয়েড মেনোপজের আগেই হয়ে থাকে, তবে কারও কারও ক্ষেত্রে মেনোপজের সময়েও ফাইব্রয়েড হয়ে থাকে। চিকিৎসক সব থেকে ভালো ভাবে বলতে পারবেন, যে এর সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি কি হবে এবং সার্জারীর প্রয়োজন আছে কিনা, বা কেমন সার্জারীর প্রয়োজন হবে। যেসব ক্ষেত্রে ফাইব্রয়েডের ফলে কোনো রোগলক্ষণ দেখা যায় না, সেসব ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসা না করলেও চলে।