প্রতিদিনের নানা টানাপোড়েনে আমরা সবাই কমবেশি উপলব্ধি করেছি যে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্ক সুস্থ রাখার উপায় হিসেবে মাইন্ড ডায়েট অত্যন্ত কার্যকর। যেকোনো মানসিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতেই প্রয়োজন সঠিক নিয়মবিধির। শরীর সুস্থ রাখতে যেমন ডায়েট ও এক্সারসাইজের কোনো বিকল্প নেই, ঠিক তেমনই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও চাই সঠিক পথ্য৷ এমনিতেও শরীরকে সুস্থ রাখতে শরীর আর মস্তিষ্কের সমন্বয় বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। আর এই সমন্বয় বজায় রাখার জন্য মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্য ধরে রাখা আবশ্যক। অর্থাৎ সুস্থ-সবল শরীরের জন্য যেমন নানা রকম খাবার আমরা আমাদের রোজকার ডায়েটে রাখি, তেমনই মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্যের জন্যেও প্রয়োজন সঠিক ডায়েট। আর তাই মস্তিষ্কের সুস্থতার জন্য বিশেষ ভাবে চাই ‘মাইন্ড ডায়েট’।
শুধু মনের সুস্থতাই নয়, অ্যালঝাইমার্স রোগকে ঠেকাতেও ‘মাইন্ড ডায়েট’ অনবদ্য। যত বেশি দিন ধরে এই ডায়েট খাওয়া হয়েছে, তার উপকারীতাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। এই তথ্যটি তাদের বিভিন্ন সমীক্ষায় জানিয়েছে জার্নাল অব অ্যালঝাইমার্স অ্যান্ড ডিমেনশিয়া, দ্য জার্নাল অব দ্য অ্যালঝাইমার্স অ্যাসোয়িয়েশন।
বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, যাঁরা নিয়মিত মাইন্ড ডায়েট অনুযায়ী খাবার খান, তাঁদের মধ্যে অ্যালঝাইমার্স ডিজিজের আশঙ্কা প্রায় ৫৩ শতাংশ কমে যায়। আর কেউ যদি সম্পূর্ণ ভাবে মেনে চলতে না পারলেও মাঝেমধ্যে খান, তাঁদের কমে প্রায় ৩৫ শতাংশ অব্ধি৷
মাইন্ড ডায়েট কী?
এই মাইন্ড ডায়েট বানানো হয়েছে হার্টের সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় মেডিটেরিয়ান ডায়েট এবং সঠিক রক্তচাপ বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ড্যাশ ডায়েট-এর উপকারের কথা মাথায় রেখে। এই ‘মাইন্ড ডায়েট’-এর প্রবক্তা হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘রাশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি সেন্টার’ এর পুষ্টিবিদ বা নিউট্রিশনাল এপিডেমিওলজিস্ট মার্থ ক্লেয়ার মরিস। ঠিক মতো মেনে চলতে পারলে এই ডায়েট দূরে রাখবে পারকিনসন্স, অ্যালজাইমার্সের মতো গুরুতর স্নায়ুর সমস্যাকে। তবে এই মাইন্ড ডায়েট মেনে চলা মানে ভাজাভুজি সরিয়ে মন দিতে হবে ভেষজ খাদ্যদ্রব্যতে। তাই বাদ দিতে হয় মিষ্টি, যেকোনো প্রসেসড খাবার, আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং রেড মিট। আর ড্যাশ ডায়েটে যেমন খাবারে নুনের পরিমাণ তথা সোডিয়ামের মাত্রা কম রাখা হয়, ব্লাড প্রেশার বাড়াতে পারে এমন সব খাবারই বন্ধ থাকে, এখানেও জারি থাকবে সেই একই নিয়ম।
এই ডায়েটের বিশেষত্বই হলো, এখানে দশ রকম স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হয় এবং যেকোনো অস্বাস্থ্যকর খাবার থেকে একেবারেই দূরে থাকতে হবে৷
মস্তিষ্ক সুস্থ রাখার উপায় -খেতে পারেন এই ১০ টি খাবার
১. সবুজ শাক সবজি
প্রতি সপ্তাহে অন্তত ছ’বার বা তার বেশি খেতেই হবে সবুজ শাক। পালংশাক, ব্রাক্ষ্মী শাক, নটে শাক, যেকোনো সবুজ শাক সবজি এবং গ্রিন স্যালাড রাখতে হবে খাদ্য তালিকায়।
২. যেকোনো সবজি
সবুজ শাক সব্জির সাথে সাথে যেকোনো রকম সবজি খান, দিনে অন্তত একবার৷ স্টার্চের পরিমাণ কম আছে বা নেই — এরকম সবজি পছন্দ করলে ভালো হয়। কারণ এতে পুষ্টিগুণের সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরিও থাকে।
৩. ব্লু বেরি বা ব্ল্যাক বেরি
বেরি খান সপ্তাহে অন্তত দু’দিন ৷ সাধারণত স্ট্রবেরির কথা বলা হলেও, ব্লু বেরি, ব্ল্যাক বেরি যেকোনো একটা বা দুটো খেতে পারেন ৷ বেরিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে, যা মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
৪. বাদাম
সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন বা তার বেশি, খাদ্য তালিকায় রাখুন বাদামকে ৷ আমন্ড, পেস্তা বাদাম, কাঠ বাদাম, পি নাট, যেকোনো বাদামই খেতে পারেন ৷ বাদাম বহু পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি খাদ্য দ্রব্য৷
৫. অলিভ অয়েল
প্রতিদিনের রান্নায় অন্য তেলকে বাদ দিয়ে অলিভ অয়েলকে জায়গা দিন ৷ হার্টের পাশাপাশি মস্তিষ্ককেও সুস্থ রাখে অলিভ অয়েল৷
৬. গোটা শষ্য বা Whole Grain
প্রতিদিন অন্তত তিনবারের খাবারে রাখুন যেকোনো গোটা শষ্যকে। সাধারণত ওটমিল, কুইনোয়া, ব্রাউন রাইস, হোল হুইট পাস্তা, হোল গ্রেইন আটার রুটি — ইত্যাদি যেকোনো খাবার রাখুন ডায়েটে ৷
৭. মাছ
সপ্তাহে অন্তত এক থেকে দু’দিন মাছ নিয়ম করে খান। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ খান বেশি করে ৷ সালমন, টুনা ইত্যাদি মাছ খাওয়া যেতে পারে।
৮. বিনস
সপ্তাহে অন্তত চারদিন খাদ্য তালিকায় রাখুন বিনস কে ৷ যেকোনো সয়া বিনস, লেন্টিলস ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় রাখুন।
৯. পোল্ট্রির মাংস
সপ্তাহে অন্তত দু’দিন চিকেন বা টার্কির মাংশ খান ৷ তবে ভাজা মাংস বা ফ্রায়েড চিকেন একেবারেই খাওয়া যাবেনা। মাইন্ড ডায়েটের নিয়মেই খেতে হবে।
১০. ওয়াইন
পড়তে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি, প্রতিদিন এক গ্লাস ওয়াইন মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখে ৷ সাদা বা লাল যেকোনো ওয়াইনই খেতে পারেন। তবে সমীক্ষা অনুযায়ী লাল ওয়াইনই বেশি খেতে বলেন এক শ্রেণীর গবেষকরা। এবং রেড ওয়াইন অ্যালঝাইমার্স রোগের প্রকোপ থেকেও মুক্তি দেয়।
মস্তিষ্ক সুস্থ রাখতে কী কী খাবেন না
মস্তিস্ক সুস্থ রাখতে গেলে নিম্নলিখিত ৫ টি খাবার যতটা সম্ভব কম খাওয়ার চেষ্টা করুন।
১. মাখন বা বাটার এবং মার্জারিন
প্রতিদিন এক টেবল চামচেরও কম অর্থাৎ ১৪ গ্রামের কম পরিমাণ বাটার বা মার্জারিন খাওয়া যায়। সম্ভব হলে এটিও বাদ দিয়ে এর বদলে অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন ৷
২. চিজ
চিজকে খাদ্য তালিকা থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়াই ভালো। তা নাহলেও সপ্তাহে গড়ে একদিনের কম রাখতে হবে খাদ্য তালিকায়
৩. রেড মিট
প্রতি সপ্তাহে সর্বোচ্চ একদিন খাওয়া যেতে পারে রেড মিট। খাসির মাংস, পর্ক, ল্যাম্ব ইত্যাদি খুব সামান্য পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে।
৪. তেলে ভাজা বা ফ্রায়েড খাবার
মাইন্ড ডায়েটে সবচেয়ে বেশি বারণ করা হয় এই তেলে ভাজা খাবার খেতে। বিশেষ করে রেস্তোরাঁ বা ফুড স্টলে বানানো ফাস্ট ফুডকে খাদ্য তালিকা থেকে পুরোপুরি বাদ দিতে বলা হয়। সপ্তাহে একদিনের কম তেলে ভাজা খাওয়া যেতে পারে।।
৫. মিষ্টি কেক প্রেস্ট্রি
এই ধরনের জাঙ্ক ফুড এবং ডেজার্টকে খাদ্য তালিকায় যত কম রাখা যায় ততই ভালো। আইসক্রিম, কুকিজ, কেক, ব্রাউনি, লজেন্স, ক্যাডবেরি — ইত্যাদি সপ্তাহে চার বারের বেশি কখনোই না৷