মুখের ক্যান্সার হল মুখের যে কোনো অংশে যেমন ঠোঁট, মাড়ি ,জিভ বা জিভের তলায়, মুখ গহ্বরের নিচের অংশে কিংবা নিচের অংশে গজিয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কোষ। মুখের ক্যান্সার প্রথমে শুরু হয় মুখের পাতলা স্কোয়ামাস কোষ থেকে। যখন ঠোঁট বা মুখের কোষগুলোর DNA মিউটেশন ঘটার ফলে কোষগুলো অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ কোষগুলি ভেঙ্গে জন্ম নেয় ক্যান্সার কোষ কার্সিনোমা। বিশ্বব্যাপী মুখের ক্যান্সারে আক্রন্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে, গণনা অনুযায়ি ভারতে প্রতি ১লাখ লোকের মধ্যে ২০ জন এই মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এবং প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৫ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন এই মুখের ক্যান্সারে।
মুখের ক্যান্সারে ঝুঁকির কারণ
- ধূমপান
- তামাক চিবানো
- অ্যালকোহল
- দুর্বল অনাক্রম্যতা বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
- উচ্চ রক্তচাপ
- পূর্ববর্তী কোনো ক্যান্সারে আক্রমণ।
- বংশ পরম্পরা বা জিনগত
- হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস
- কিছু রাসয়নিক পদার্থ যেমন সালফিউরিক এসিড, আসবেষ্টসিস, ফর্মালডিহাইডর সংক্রমণে মুখের ক্যান্সার ঘটতে পারে।
- মাথা , ঘাড় বা উভয়েরই পূর্বের কোনো রেডিও থেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা।
- গাষ্ট্র ইন্টেস্টাইনাল রিফ্লাক্স ডিজিস এ পেটের অ্যাসিড মুখ পর্যন্ত ওঠে আসা দীর্ঘদিন এর ফলে মুখের ক্যান্সার হতে পারে।
মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ
- যদি ঠোঁট বা মুখের ঘা না শুকায়
- খাবার গিলতে অসুবিধে হয়
- কানের যন্ত্রণা
- গলা ব্যাথা
- মুখে বা ঘাড়ে অস্বাভাবিক যন্ত্রণা
- কোনো কারণ ছাড়াই মুখে রক্তক্ষরণ
- জিভ মুখের মধ্যে ঘোরাতে অসুবিধে
- দাঁতের স্বাভাবিক গঠন আলগা হয়ে যাওয়া।
- গলার স্বর বদলে যাওয়া।
- মুখের ভিতরে বা জিভের উপর সাদা বা লাল রঙের ছোপ বা আস্তরণ দেখা দিলে।
- শারীরিক ওজন হ্রাস পাওয়া
যদি এরকম কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় ও তা ৩ সপ্তাহের মধ্যে নিরাময় না হয় তবে একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞর পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে।এটি মারণ ব্যাধি কিন্তু তা উপযুক্ত চিকিৎসায় নিরাময় সম্ভব যদি তা প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসা করা যায়।
মুখের ক্যান্সার রোগনির্ণয়ের জন্য কি ধরনের পরীক্ষা প্রয়োজন হয়?
টিস্যু পরীক্ষা: এই সময় ক্যান্সারযুক্ত কোষের উপস্থিতি পরীক্ষা করার জন্য ক্ষত স্থান থেকে টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করা হবে।
এক্সরে: ক্যান্সার কোনও হাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কিনা তা দেখার জন্য মুখ এবং গলার এক্স-রে করা হয়। ক্যান্সার দাঁত ও চোয়াল পর্যন্ত কতটা ছড়িয়ে পড়েছে তা দেখতে Orthopantomogram (OPG) হিসাবে পরিচিত একটি বিশেষ এক্স-রে ব্যবহার করা হয়।
এফ এন এ পরীক্ষা: লিম্ফ নোডগুলিতে কোন ক্যান্সার কোষ আছে কিনা তা দেখার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় গলার লিম্ফ নোড গুলি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক আছে ত দেখা হয়।ডাক্তার লিম্ফ নোডের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সুচ পাস করিয়ে কিছু কোষকে একটি সিরিঞ্জে নেওয়া হয় এবং মাইক্রোস্কোপের অধীনে নমুনাটি পরীক্ষা করা হয়। এটি একটি দ্রুত প্রক্রিয়া যা সহজেই ক্যান্সারের কোষ গুলিকে চেনা যায়।
কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যান: কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি স্ক্যানর মাধ্যমে ক্ষতিকারক ক্যান্সার রোগের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। পরীক্ষাটি করতে প্রায় 10-30 মিনিট সময় লাগে।
পেট সিটি স্ক্যানঃ এটির মাধ্যমে ক্যান্সার শরীরের লসিকা গ্রন্থি বা লিম্ফনোডে ছড়িয়েছে কি না তা দেখা হয়।
এন্ডোস্কপি: নাসিকা গহ্বর, গলার ভিতরে, সাইনাস প্রভৃতি অংশে ক্যান্সারের বিস্তার চিহ্নিত করতে এন্ডোস্কপির ব্যাবহার করা হয়
মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা
সার্জারি– প্রাথমিক অবস্থায় মুখের ক্যান্সার ধরা পড়লে ক্যান্সারে আক্রান্ত টিউমার বা লিম্ফনোডগুলি সার্জারির মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়।
রেডিয়েশান থেরাপি– একধরনের এক্স-রে এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। আক্রান্ত স্থানকে চিহ্নিত করে ওই বিশেষ স্থানে এই রে বা রশ্মি প্রেরণ করে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলিকে ধ্বংস করা হয়।
কেমোথেরাপি– এটি একধরনের ওষুধ যা ইঞ্জেক্সানের মাধ্যমে অথবা মুখে খাওয়া ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়, অনেক সময় রোগীর ক্যান্সারের ধরন এবং অগ্রগতির উপর নির্ভর করে কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশান থেরাপি একত্রে প্রয়োগ করা হয়।
টার্গেটেড থেরাপিঃ এটি একধরনের আধুনিক চিকিৎসা যা প্রাথমিক অথবা আডভান্স উভয় স্টেজেই ব্যাবহার করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি আটকে দেওয়া হয়।
মুখের ক্যান্সারে চিকিৎসা চলাকালীন বা চিকিৎসার পর কি খাবেন?
মুখের ক্যান্সারে চিকিৎসা চলাকালীন বা চিকিৎসার পরে কি খাওয়া যাবে কতটা খাবেন তা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। এই রকম মারন রোগের হাত থেকে বাঁচতে সঠিক খাদ্য নির্বাচন তা খুব দরকারি হয়ে পড়ে। এইসময় এমন কিছু খাদ্য নির্বাচন করতে হবে যা আমাদের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে এবং ক্যান্সারে নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষ গুলিকে পুনরায় গঠন করবে।তাই খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে উচ্চ মানের প্রোটিন যা নতুন কোষ তৈরি করবে ।ডিম ও দুধের পুষ্টি গুন সবথেকে বেশি হওয়ায় ডিম ও দুধ তো রাখতেই হবে তার সাথে রাখতে হবে মাছ, সোয়াবিন,ডাল, মুরগির মাংস, ইত্যাদি। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে খাদ্যে গ্রহণ করা যাবে টাটকা ফল ও সবুজ শাক সবজি। হলুদ ও কমলা রঙের সবজিতে আছে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন যা অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ও ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, রাস্পবেরি তে আছে এলিগিন নামক ফাইটো উপাদান যা ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধি মন্থন করে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এছাড়াও যদি খাদ্য তালিকায় ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন মুসম্বি, বাতাবি,কমলা,পেয়ারা রাখা যায় তবে ২৪% ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। তবে খাদ্যতালিকা থেকে মিষ্টি, লবণ, খুব মশলা, ঘী , চর্বি জাতীয় খাবার রাখা যাবেনা।
খাদ্য গ্রহণে কিছু টিপস:
ক্যান্সারে চিকিৎসা চলাকালীন বা পরবর্তী সময়ে রোগীর খাদ্যে অনীহা দেখা যায় তবে সে ক্ষেত্রে কম করে খাবার বার বার দিতে হবে।
যেযে কোনও খাবার খাওয়ার আগে খুব ভালো করে মুখ ধুয়ে নিতে হবে। সবসময় ঠান্ডা খাবার দিতে হবে ।
ধূমপান ও অ্যালকোহল পান করা যাবেনা।