বয়সের সাথে সাথে যেমন মরচে পরে শরীরে, তেমনই জং ধরে মস্তিষ্কেও। নার্ভের রোগের লক্ষণ, কারণ এবং প্রতিকার কিভাবে সম্ভব বিস্তারিত জানুন এবং অন্যদের জানতে সাহায্য করুন।
বয়সের সাথে সাথে কমজোর হয় স্নায়ু অর্থাৎ নার্ভের সক্রিয়তা। ফলত শরীরে বাসা বাঁধে স্নায়ু ঘটিত নানান রোগ ৷
কিন্তু সমস্যা হলো, যেহেতু সেই অর্থে কোনো পূর্ব উপসর্গ থাকে না, তাই স্নায়ুঘটিত রোগের বিস্তৃতি ও জটিলতা সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রেই সেভাবে আমাদের স্পষ্ট তেমন ধারণা থাকে না। তাই কখন সচেতন হতে হবে, তা আমরা সেই অর্থে বুঝতেও পারি না। এ দিকে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ সময় হাত থেকে পেরিয়ে যায়।
তবে স্নায়ুঘটিত সব রোগই যে বয়স বাড়লে হয় এমনটা নয়, এর ব্যতিক্রমও আছে, যা একেবারেই বয়সের উপর নির্ভর করে না ৷
হান্টিংটিন’স ডিজিজ
কারণ
হান্টিংটন’স ডিজিজ একটি নিউরো ডিজেনারেটিভ রোগ যা বংশানুক্রমে বাবা-মা থেকে শিশুর মধ্যে পরিবাহিত হয়। বাবা অথবা যেকোনো একজন বা দুজনের ক্রোমোজমের একটু ত্রুটিপূর্ণ জিন সন্তানের দেহে পরিবাহিত হলে এই রোগ সৃষ্টি হয়।
লক্ষণ
হান্টিংটন’স ডিজিজ-এর উপসর্গ গুলি মোটামুটি ভাবে ৩০-৫০ এর মধ্যে দেখা দিতে শুরু করে ৷ যেমন—
• নিয়ন্ত্রণহীন চলাফেরা
• ডিপ্রেশন
• হ্যালুসিনেশন
• অনিচ্ছাকৃত চলাফেরা
• নতুন কোনো তথ্য বা কথাকে বুঝতে অসুবিধা হওয়া
• সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা
রোগের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে আরও বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন —
• স্মৃতিশক্তি হ্রাস
• হাঁটাচলায় সমস্যা
• ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন
• কথাবার্তায় পরিবর্তন
• জ্ঞানের পরিধি হ্রাস
চিকিৎসা
• অনিচ্ছাকৃত চলাফেরার চিকিৎসায় Tetrabenazine এবং Antipsychotic ড্রাগ প্রয়োগ করা হয়।
• পেশীর কাঠিন্য এবং অনিচ্ছাকৃত সংকোচনের জন্য Diazepam প্রয়োগ করা হয়।
• ডিপ্রেশন এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার থেকে মুক্তির জন্য Antidepressant এবং Mood-stabilizing ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
• পারস্পরিক যোগাযোগ, ভারসাম্য এবং নমনীয়তা সংক্রান্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে থেরাপি ভীষণ ভাবে কার্যকরী।
• হাঁটাচলা, খাওয়া, স্নান করা, জামাকাপড় পরা — এসব ক্ষেত্রে যাদের সমস্যা দেখা দেয়, তাদের জন্য অক্যুপেশনাল থেরাপি ভালো কাজ দেয় ৷
• যেসব আক্রান্ত ব্যক্তিরা কথা বলতে পারেন না, তাদের জন্য স্পিচ থেরাপি কার্যকরী ৷
মাইগ্রেন
কারণ
বেশ কিছু ট্রিগার ফ্যাক্টরকে মাইগ্রেনের কারণ হিসেবে ধরেন ডাক্তাররা। কখনও একটি কখনও বা একাধিক ট্রিগার ফ্যাক্টর মিলেমিশে ডেকে আনতে পারে মাইগ্রেন। ট্রিগার ফ্যাক্টরগুলির মধ্যে যেমন আছে — প্রচণ্ড রোদে বা গরমে ঘোরাঘুরি, দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে বা না খেয়ে থাকা, খালি পেটে চকোলেট, চিজ, আইসক্রিম অথবা মিষ্টি খাওয়া ৷ তেমনই পেট্রোল, ডিজেলের বা অন্য কিছুর কোনও তীব্র গন্ধ, অতিরিক্ত ঠান্ডা থেকে গরমে আসলে বা উল্টোটা , অনিদ্রা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অ্যাংজাইটি ইত্যাদি মিলেমিশে শুরু হতে পারে মাইগ্রেনের আক্রমণ। পৃথিবীর প্রায় ১৪.৭% মানুষ মাইগ্রেনের সমস্যায় ভোগেন।
উপসর্গ
ব্যথা ছাড়াও যে উপসর্গ গুলি দেখা যায়
• শুধু খেতে ইচ্ছে করা
• ডিপ্রেশন
• এনার্জি কমে যাওয়া
• হাইপারঅ্যাক্টিভিটি
• বিরক্তি
ব্যথা জনিত যে উপসর্গ গুলি দেখা যায়
• মাইগ্রেনের ব্যথা কপালের একদিকে শুরু হয়ে তা চোখে এবং ঘাড়ের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
• ব্যথার সাথে বমি বমি ভাব।
• আলো বা শব্দে বিরক্তি।
• চলাফেরা বা অন্যান্য কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যায়।
চিকিৎসা
• মাইগ্রেনের চিকিৎসার প্রথম শর্তই হলো জীবনযাত্রার পরিবর্তন।
• যেসব কারণে ব্যথা বেড়ে যায় সেগুলি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলা ৷
• স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ৷
• সাধারণত যে সব ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধ প্রয়োগ করা হয় সেগুলি হলো — উচ্চমাত্রার অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন (Advil, Motrin, Midol) বা অ্যাসিটামিনোফেন।
মেনিনজাইটিস
কারণ
মেনিনজিস হল আমাদের মস্তিষ্কের একদম বাইরের আবরণ। মেনিনজিসের তিনটে স্তরের মাঝখানে থাকে অজস্র সুক্ষ্ম রক্তজালক। কোনও ভাবে এখানে জীবাণু পৌঁছে গেলেই শরীরে বাসা বাঁধে রোগ। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ারা এখানে পৌঁছে আক্রমণ করলে মেনিনজিসের প্রদাহ হয়, তাই অসুখটির নাম মেনিনজাইটিস। সংক্রমণ যদি আরও ভেতরে পৌঁছে যায়, তখন বিপদের সম্ভাবনাও মারাত্মক বেড়ে যায়। টিবি, সর্দি-জ্বর, শ্বাসনালীর সংক্রমণ, কানের ইনফেকশন, এইচআইভি-সহ যে কোনও সংক্রমণ থেকে মেনিনজাইটিসের ঝুঁকি থাকে। মেনিঙ্গোকক্কাস, স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি, স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস, হিমোফিলিস ইনফ্লুয়েঞ্জি জাতীয় নানা জীবাণু মস্তিষ্কে পৌঁছে গিয়ে মেনিনজিসকে আক্রমণ করে। আমাদের দেশে মেনিনজাইটিস সব থেকে বেশি হয় টিবির জীবাণু থেকে।
লক্ষণ
• জ্বরের সঙ্গে ভয়ানক মাথা ব্যথা
• বমি বমি ভাব
• ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া
• ঝিমিয়ে পড়া
• আলো ও শব্দ শুনলে প্রচন্ড বিরক্ত হওয়া
• ঘাড় নাড়াতে না পারা
• খিটখিটে হয়ে যাওয়া
চিকিৎসা
মেনিনজাইটিস হলে কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে যথাশীঘ্র চিকিৎসা শুরু করানো উচিত। ইন্টারভেনাস ফ্লুইডের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য ওষুধের প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি রোগীকে অনবরত মনিটর করাও দরকার। সংক্রমণ কমে গেলেও কিছুদিন বিশ্রাম একান্ত প্রয়োজন।
পারকিনসন ডিজিজ
কারণ
এটি একটি নিউরো ডিজেনারেটিভ রোগ। মস্তিষ্কের ডোপামিন তৈরির কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, অর্থাৎ ডোপামিন হ্রাস পেলে পারকিনসন রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ৬০ বছর বয়সের পর এই রোগ দেখা দেয়।
লক্ষণ
• হাত,পা,মাথা, থুতনি ও চোয়াল হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে ওঠা।
• ধীরে ধীরে শরীরের ভারসাম্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাওয়া।
• হাঁটাচলা গতি ক্রমশ কমতে থাকে এবং জড়তা দেখা দেয়।
• হাত পা ও অন্যান্য মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায়। ফলে, শরীরের যেকোনও অংশ নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়৷
• মনের মধ্যে অস্বাভাবিক উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ও অবসাদ জন্ম নেয়।
• গলার স্বরের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।যা ক্রমশ ভারি ও ক্ষীণ হয়ে যায়।
• কখনও ঘুম বেশি হয় আবার কখনও একেবারেই হয় না৷
• স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে।
• ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে যায়।
• যৌন ক্ষমতা হারিয়ে যায়।
• খাবার গিলতে সমস্যা হয়।
• অনিয়ন্ত্রিত মূত্র ত্যাগ।
• কোষ্ঠকাঠিন্য।
• ত্বকের নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।
চিকিৎসা
এই রোগ কখনোই সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হয় না। ওষুধের প্রয়োগে উপসর্গ গুলিকে কিছুটা কম করা আয়। তবে ডাক্তাররা সাধারণত অ্যারোবিক এক্সারসাইজ সহ কিছু ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন। যে ওষুধ গুলি সাধারণত প্রয়োগ করা হয়৷ সেগুলি হলোঃ
• Carbidopa-levodopa (Lodosyn)
• Inhaled carbidopa-levodopa
• Dopamine agonists — pramipexole (Mirapex), ropinirole (Requip) and rotigotine ( Neupro), Apomorphine (Apokyn)
অ্যালঝাইমার্স
কারণ
এটি একটি ক্রনিক নিউরো ডিজেনেরেটিভ ডিজিজ অর্থাৎ বয়সের সাথে সাথে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলি শুকিয়ে যাবার রোগ যার জন্য মূলত ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ এবং অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। ১৯০১ সালে একজন জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যালয় অ্যালঝাইমার (Alois Alzheimer) প্রথম একজন ডিমেনশিয়া পেশেন্টকে সনাক্ত করেন, তাই তার নাম অনুসারে রোগটির নামকরণ হয় অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ।
লক্ষণ
রোগের স্টেজ অনুযায়ী উপসর্গ গুলি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।
• স্মৃতিভ্রংশ বা মেমরি লস।
• মনোযোগ এবং একাগ্রতায় অসুবিধা, নতুন কিছু শিখতে অসুবিধা।
• নিজের বাড়ীর রাস্তা ভুলে যাওয়া।
• নিয়মিত কাজে বেশী সময় লাগা
• টাকা পয়সাকেও সঠিকভাবে চিনতে না পারা
• বিচারবুদ্ধি লোপ, চিন্তাভাবনায় অসুবিধা।
• মেজাজ পরিবর্তন এবং ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন, পেশীতে টান ধরা।
• মুখ চিনতে অসুবিধা
• অস্থিরতা, উৎকন্ঠা বৃদ্ধি পাওয়া, এমনকি রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
• ধীরে ধীরে হ্যালুসিনেশন, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হওয়া, বিরক্ত হওয়া ইত্যাদি।
• ওজন কমে যাওয়া, খিঁচুনি, ঝিমুনি।
• মূত্র নিয়ন্ত্রণের অভাব।
চিকিৎসা
• সম্প্রতি অ্যালঝাইমার্সের কার্যকরী চিকিৎসায় নতুন ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে দু’দশক গবেষণার পর। যার নাম, আড্যুহেল্ম।
• এছাড়াও এযাবতকাল রিভাসটিগমিন, ডোনেপেজিল ও মেমানটিনজাতীয় ওষুধ এই রোগের চিকিৎসায় কার্যকর।
• এছাড়াও ডাক্তার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ মতো কিছু প্র্যাকটিস নিয়মিত করলে তা চিকিৎসায় ভালো ফল দেয়।
তবে এখনও পর্যন্ত চিকিৎসাক্ষেত্রে অ্যালঝাইমার্স কে কিওরেবল ডিজিজ বলে ব্যাখ্যা করা হয়নি।
ডিমেনশিয়া
কারণ
নানা কারণেই ডিমেনশিয়া হতে পারে। যেমন, মস্তিষ্কের কোনো রোগ বা আঘাত থেকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের এমন কিছু কোষ ও নার্ভ শুকিয়ে যায়, যার জেরে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্মৃতি ও চিন্তাভাবনা, যা দৈনন্দিন রুটিনকে মারাত্মক ব্যাহত করে। ফলত সৃষ্টি হয় ডিমেনশিয়া। এছাড়াও ডাক্তাদের মতে শরীরে ভিটামিন বা খনিজ উপাদানের ঘাটতি, মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা ইত্যাদি থেকেও দেখা যায় ডিমেনশিয়া।
লক্ষণ
• স্মৃতিশক্তি হ্রাস
• বিচারবুদ্ধি লোপ
• কর্মবিভ্রাট
• ভাষা প্রয়োগে সমস্যা
চিকিৎসা
•Cholinesterase inhibitors, এই ওষুধগুলি অ্যাসিটাইলকোলিন নামে মস্তিষ্কে একটি রাসায়নিকের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এই রাসায়নিক স্মৃতির গঠনে এবং মস্তিষ্কের বার্তাকে উন্নত করতে সাহায্য করে।
• Memantine ওষুধটি মডারেট বা সিভিয়ার ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের জ্ঞান এবং আচরণগত সমস্যাকে বিলম্বিত করে।
• নন-ড্রাগ থেরাপি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওষুধের চাইতেও বেশি কার্যকর হয়। সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা, অতিরিক্ত ভিড়, চিৎকার, উত্তেজনা এড়িয়ে চলা, একজন থেরাপিস্টের সাহায্যে রোজকার টাস্ক করানো এবং গ্রুমিং ডিমেনশিয়ার চিকিৎসাতে ভালো ফল দেয়।
• অকুপেশনাল থেরাপিও ডিমেনশিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।