এ যেন কোনও স্ক্রিন নয়, একখানি আস্ত কৃষ্ণগহ্বর! আকারে ছোট্ট মোবাইল স্ক্রিন ধীরে ধীরে গিলে নিচ্ছে শৈশব! কোন অতলে লুপ্ত হচ্ছে শিশুর সুকোমল মনোবৃত্তি! মোবাইলে বুঁদ খুদেরা এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর মানসিক সঙ্কটের সামনে। নীল আকাশ, রঙিন ফুল, পাখি
চেনার আগেই সে শিখে নিচ্ছে চ্যাট, লাইক, মিম, শেয়ার, বুলিং, রিলস-এর মতো শব্দ! দাদু-ঠাকুমার স্নেহের স্পর্শের অনুভূতির আনন্দ তার মস্তিষ্ক ঢেকে রাখার বদলে সেখানে গিজগিজ করছে টম-অ্যান্ড জেরির হিংসাত্মক কার্যকলাপ! মাশার দুষ্টুমি। তার ব্রেন এতখানিই কৃত্রিম জগতের উল্লাসে পুলকিত হচ্ছে যে বাস্তবের পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সংযোগ যাচ্ছে কমে। সে শিখছে না কীভাবে বলতে হয় কথা। কীভাবে অন্যের সঙ্গে স্থাপন করতে হয় যোগাযোগ।
একসময় বাবা-মায়েরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা মনোবিদের কাছে এসে অভিযোগ করছেন— ‘খেতে, বসতে, শুতে শুধু মোবাইল! ফোন ফেরত চাইলেই চিল চিৎকার করছে। কোনওভাবেই থামানো যাচ্ছে না! পড়াশোনাও করতে চাইছে না। কোনও বন্ধু নেই। একা একা থাকছে। কিছু বলতে গেলে রেগে গিয়ে হাত চালাচ্ছে! আচার আচরণে অত্যন্ত আগ্রাসী হয়ে উঠছে।’
চিকিৎসকরা বলছেন, মোবাইল ফোনে কার্টুন কিংবা পছন্দমতো ভিডিও দেখলে বা গেম খেললে মস্তিষ্কে ডোপামিন ক্ষরণ হয়। এই হরমোনটি ব্রেনে আনন্দদায়ক অনুভূতি তৈরি করে। ফলে বারংবার ডোপামিন ক্ষরণজনিত ওই আনন্দদায়ক অনুভূতি পেতে ইচ্ছে করে বাচ্চাদের। তাই বারবার মোবাইল দেখার ইচ্ছে তৈরি হয়। এভাবেই ওরা মোবাইলে আসক্ত হয়ে ওঠে। বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই এই আসক্তি কাটানো প্রয়োজন।
সমস্যা হল বেশিরভাগ বাবা-মায়েরাই জানেন না একরত্তির মোবাইলে আসক্তি এলে তা কাটাবেন কীভাবে! এই সমস্যাটির কথা মাথায় রেখেই ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স কলকাতার পক্ষ থেকে পূর্ব ভারতে এই প্রথম চালু হল ক্লিনিক ফর ইন্টারনেট গেমিং অ্যান্ড মিডিয়া অ্যাডিকশন সেন্টার।
আগে বেঙ্গালুরুতে এই ধরনের ক্লিনিক চালু হলেও পশ্চিমবঙ্গে এমন উদ্যোগ প্রথম। হাসপাতালের নিউরো সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান ডাঃ প্রবীণ কুমার জানিয়েছেন, বাচ্চার হাতে মোবাইল কিন্তু বাবা-মা প্রথম তুলে দেন। মূলত বাচ্চাকে দ্রুত খাবার খাওয়াতে গিয়েই এই ভুলটা করে ফেলেন অভিভাবকরা। এরপর সন্তান ইউটিউব, ইন্টারনেট সম্পর্কে জানতে পারে। ক্রমশ জানতে পারে বিভিন্ন গেম সম্পর্কে। বাড়তে থাকে আসক্তি। পড়াশোনার ফল খারাপ হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন, দেখা দিচ্ছে আরও নানা সমস্যা। মোবাইলে বুঁদ কীভাবে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হয় তাও শিখতে পারছে না। আসক্তি এমন জায়গাতেও পৌঁছে যাচ্ছে যে বাচ্চার খাবার খাওয়ার প্রতিও আগ্রহ থাকছে না। খাবার খেতেও দেরি হচ্ছে যা তৈরি করছে পুষ্টির সমস্যা। এছাড়া রাত জেগে মোবাইল দেখার কারণে অনিদ্রার সমস্যা তৈরি হচ্ছে যা আবার মানসিক নানা জটিলতা তৈরি করছে। খেলাধুলো না করার জন্য শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে।
নিউরো সাইকিয়াট্রি বিভাগের চিকিৎসকরা বলছেন, ২ বছরের কম বয়সি বাচ্চাকে কখনওই মোবাইল ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। এই বয়সের বেশি বয়সের বাচ্চারা সারাদিনে বড়জোর ১ ঘণ্টা মোবাইল দেখতে পারে। তবে সেই সময়েও মোবাইলে চালাতে হবে শিক্ষামূলক কোনও ভিডিও। বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া মোবাইল দেখা যাবে না। বাচ্চা কী দেখছে তার দিকেও রাখতে হবে নজর।
ক্লিনিকের উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের মন্ত্রী শশী পাঁজা। তিনি বলেন, করোনার সময়ে পড়াশোনার কারণে শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দিতে হয়েছিল। তবে সেই অভ্যেস থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরে আসা দরকার।