গর্ভাবস্থায় কি খাওয়া উচিত তা প্রত্যেক গর্ভবতী মায়েদের জানা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক খাওয়া-দাওয়ার ওপর গর্ভবতী মা এবং তাঁর বাচ্চার সুস্থতা নির্ভর করে। মা হওয়া একজন মহিলার জীবনে সবচেয়ে সুখকর অনুভুতিগুলির মধ্যে অন্যতম । একজন মা তাঁর নিজ দেহে অত্যন্ত যত্নের সাথে শিশু কে ছোট্ট ভ্রুন থেকে নবজাত শিশুতে পরিনত করেন দীর্ঘ ৪০ সপ্তাহ সময় ধরে । একজন মায়ের প্রি- প্রেগন্যান্সি স্বাস্থ্য ( প্রেগন্যান্সির আগে শারীরিক অবস্থা) এবং প্রেগন্যান্সি চলাকালীন সময়ের শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে তাঁর বাচ্চা শারীরিক এবং মানসিক দিকে কতটুকু সুস্থ , সুন্দর এবং সাবলীল হবে । একজন মায়ের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে তাঁর বাচ্চার স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে অপরদিকে মায়ের স্বাস্থ্য তুলনামুলক খারাপ থাকলে স্বাভাবিক ভাবেই তার বিপরীত হবে ।
ICMR এর নির্ধারিত রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী একজন নর্মাল মহিলা থেকে একজন প্রেগন্যান্ট মহিলার দৈনিক গড় ক্যালোরি চাহিদা ৩৫০ কিলোক্যালরি ( 2480 KCAL, ESTIMATED AVERAGE REQUIREMENTS AS PER ICMR REPORT 2020 ) থেকে বেশী হয় । দৈনিক গড় ক্যালোরি চাহিদার পাশাপাশি প্রোটিন , ফ্যাট , ভিটামিন এবং মিনারেলস এর চাহিদাও কম বেশী বেড়ে যায় । এই লেখার মাধ্যমে খুব সাধারন ভাবে প্রেগ্নান্সির সময় কেনো সুষম ( Balance Diet ) খাবাররের প্রয়োজন এবং কী ধরনের খাবার খাওয়া প্রয়োজন , সে সম্পর্কে সাম্যক ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করবো ।
গর্ভবতী মহিলাদের কেন সুষম খাবার খাওয়া প্রয়োজন?
- একজন শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ মহিলাই একজন সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারেন । ন্যশন্যাল ফ্যামিলি এন্ড হেল্থ সার্ভে ২০১৫-১৬ সালে ১৫ থেকে ৪৯ বয়সী ৬৫১,৬৪২ জন নন প্রেগন্যান্ট মহিলার মধ্যে সার্ভে করে ভারতীয় মহিলাদের অপুষ্টি এবং রক্তাল্পতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন । গবেষণায় প্রকাশ ভারতের ২২.৪ শতাংশ মহিলা মহিলাই অপুষ্টির শিকার অর্থাৎ দৈনন্দিন ক্যালোরি চাহিদা পূরণ করতে পারেন না , যার জন্য অনেকের শারীরিক ওজন কম থাকে । ফলস্বরুপ একজন মহিলা ২.৫ কেজির কম ওজন সম্পন্ন শিশুর ( Low Birth Weight ) জন্ম দিয়ে থাকেন । প্রি-প্রেগন্যান্সি ওজন যদি ৪০ কেজির কম হয় তাহলে ওই মহিলার আগত সন্তান ২.৫ কেজির কম (Low Birth Weight ) হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে । তাই সন্তান নেওয়ার পূর্বে খেয়াল রাখতে হবে যে আপনার ওজন যাতে কখনই ৪০কেজির কম না হয় । ওজন কম হলে একজন চিকিৎসক অথবা ডায়েটিসিয়ান এর পরামর্শ নিন ।
- গ্লোবাল নিউট্রিশন রিপোর্ট ২০১৭ অনুযায়ী ভারতের প্রায় ৪৮ শতাংশ মহিলাই রক্তাল্পতায় ভুগছেন যা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় ।
- প্রেগন্যান্সি চলাকালিন সময় সাধারনত একজন মহিলার শারীরিক ওজন গড়ে ১১ থেকে ১৩ কেজি বৃদ্ধি পায় এবং তা ব্যক্তি বিশেষ ভিন্নও হতে পারে । এটা বলা হয় যে প্রেগন্যান্সির ২০ সপ্তাহের পরে কম ওজন বাড়ার ফলে ৩৭ মাসের আগেই শিশুর জন্ম হতে পারে যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় প্রিম্যাচিউর বেবি বলা হয় ।
উপরের এই সমস্যাগুলি সাধারনত ভারতের শহর এবং গ্রমাঞ্চলের আর্থিক এবং শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা পরিবারেই বেশীর ভাগ লক্ষ্য করা যায় এবং এই সমস্যা গুলকে সুষম খবারের (Balance Diet ) মাধ্যমে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় ।
গর্ভাবস্থায় কি খাওয়া উচিত? গর্ভবতী মহিলাদের প্রয়োজনীয় ডায়েট
সুষম খাদ্য সবার জন্য প্রয়োজনীয় , তবে প্রেগন্যান্সি চলাকালীন অবস্থায় প্রয়োজনের ভিত্তিতে প্রতিদিনের খাবারে সামঞ্জস্য বজায় রাখা মা ও তাঁর গর্ভস্থ শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । গর্ভাবস্থায় কোন কোন খাবার গুলি ভালো সেগুলো জানা বিভিন্ন লক্ষণ যেমন বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অম্বল, পায়ের ত্বক এবং মাথা ব্যথা ইত্যাদির সমাধান করতে সহায়তা করবে এবং আপনার শিশুর পুষ্টি জোগাবে । এই সময়ে চিনি এবং লবণ রয়েছে এমন প্যাকেজযুক্ত অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলি অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকা দরকার ।
চাল , গম , ভুট্টা ইত্যাদি কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার
এই ধরনের খাবার গুলি শক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং এগুলি ফাইবার আয়রন , ফলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন বি সরবরাহ করে , যা আপনার শিশুর শারীরিক বিকাশের জন্য উপকারী । একজন গর্ভবতী মহিলার ক্যালোরি চাহিদার অর্ধেক ভাত ,রুটি ,ওটমিল , পাউরুটি ,পাস্তা (whole-wheat pasta) ইত্যাদি খাবার থেকে আসা উচিত । তাছাড়া এগুলি কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অর্শ্বরোগকেও প্রশমিত করে প্রেগন্যান্সির সময়ে কিছু স্বস্তি প্রদান করে ।
প্রোটিন জাতীয় খাবার
ICMR এর তথ্য অনুযায়ী একজন গর্ভবতী মহিলার প্রতিদিনের গড়ে ৫৫ গ্রাম প্রোটিনের চাহিদা থাকে । প্রোটিন জাতীয় খাবারগুলি শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের সাথে সাথে আপনার শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদাও পুরন করে । প্রোটিন হাড়, পেশী, মস্তিস্ক এবং অঙ্গগুলির জন্য নতুন টিস্যু তৈরি করে, তাই বাচ্চার সঠিকভাবে বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে একজন গর্ভবতী মহিলার প্রতিদিন প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন মাছ , মাংস, ডিম ,সয়াবিন , বাদাম , এবং বিভিন্ন ধরনের ডাল জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক ।
দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার
দুগ্ধজাত খাবার যেমন দুধ , দই , পনির ইত্যাদি প্রোটিন এবং ক্যালসিয়ামের উৎস, যা আপনার শিশুর হাড়ের বিকাশে সহায়তা করে । বাজার থেকে দুগ্ধজাত পণ্যগুলি নিন যেগুলি কম ফ্যাটযুক্তএবং গর্ভাবস্থায় যেহেতু দেহে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে তাই দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার পেস্টুরাইজড করা আছে কিনা দেখে কিনুন ।
সবুজ শাক সব্জি এবং ফল
সবুজ শাকসবজি , ফল ভিটামিন্স এবং মিনারেলস এর আদর্শ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয় ।
দিনে কমপক্ষে ৫ ভাগ ফল ও শাকসবজি খাওয়ার চেষ্টা করুন । বিভিন্ন ধরণের রঙের সব্জি এবং ফল খাওয়া ভাল, যা তাজা, ফ্রিজে রাখা , শুকনো এবং ক্যানড যে কোন রকমের হতে পারে । এগুলি রান্না করে খাওয়ার পাশাপাশি যেগুলো কাঁচা খাওয়া যায় যেমন টমেটো, শসা , গাজর, বিট ইত্যাদি প্রতিদিন স্যলাদ করে অথবা স্যান্ডউইচগুলিতে যোগ করে খাওয়া যেতে পারে । তাছারা সবুজ শাকসবজি এবং ফল সাধারনত ফাইবারের একটি ভাল উৎস যা কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করতে সহায়তা করে । বাজার করতে গেলে সম্ভব হলে মরসুমে সব্জিগুলি বাছাই করে কেনার চেষ্টা করুন , কেননা মরসুমি ফসল যেমন পুষ্টিকর স্বাস্থ্যসম্মত তেমনি তুলনামুলক কিছুটা সস্তাও হয় । মোটকথা নিজের এবং বাচ্চার স্বাস্থ্য ভালো করতে প্রতিদিন আপনার প্লেটে বেশী পরিমানে সবুজ শাক সব্জি এবং ফল যুক্ত করতে একদম কার্পণ্য করবেন না ।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং তেল জাতীয় খাবার(পরিমাণ মত)
যদিও গর্ভাবস্থায় অনেকগুলি খাদ্যের বিধিনিষেধের মধ্যে ফ্যাট এবং তেল জাতীয় খবার কে উপরে রাখা হয়েছে তবু বিশেষজ্ঞরা একে কখনই পুরপুরি ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন না কারন এগুলি আপনার শিশুর মস্তিস্ক এবং চোখের জন্য বিশেষ ভাবে উপকারী । তবে তেলের পরিমাণ প্রতিদিন ৬ চামচের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত । বিভিন্ন রকমের প্রসেস ফ্যাট ( যেমন মাখন ) কম খাওয়া উচিত কারন এগুলি অতিরিক্ত ওজন বাড়ানোর জন্য দায়ী ।
স্বাস্থ্যকর খাবারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর পানীয়
প্রতিদিন পরিমিত জল পান করুন, কারন জল গর্ভাবস্থার বিভিন্ন লক্ষণগুলি যেমন বমি বমি ভাব দূর করতে সহায়তা করতে পারে । বিপরীতে, ডিহাইড্রেশন, বিশেষত এটি যদি প্রেগন্যান্সির তৃতীয় ত্রৈমাসিকের (২৭ থেকে ৪০ সপ্তাহ )সময় ঘটে তবে এটি প্রিম্যাচিউর বেবি জন্মদানের সম্ভাবনা রয়েছে । সোডা এবং কফি খাওয়া কমিয়ে পরিবর্তে জল এবং সীমিত ( অতিরিক্ত ফলের রস রক্তে সুগার এর মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে ) ফলের রস খাওয়ার অভ্যাস করুন । প্রেগন্যান্সি চলাকালীন সময়ে অ্যালকোহল এবং ধুমপান সহ যে কনও ধরনের নেশা এড়িয়ে চলুন কারণ এটি আপনার শিশুর স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব ফেলবে । এমনকি শিশুর জন্মের পরেও স্তন্যপান করানোর সময় এই একই সতর্কতাগুলি (অ্যালকোহল সীমাবদ্ধ সহ) অনুসরণ করা প্রয়োজন ।