প্রোবায়োটিক বলতে আমরা সেই সব জীবিত ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকদের বুঝি যেগুলি আমাদের শরীরের পক্ষে উপকারী।আমাদের শরীর ভালো এবং খারাপ উভয় প্রকার ব্যাকটেরিয়াতে পরিপূর্ণ। প্রোবায়োটিককে ভালো ব্যাকটেরিয়া বলা হয়। প্রোবায়োটিক আমাদের সমগ্র শরীরের বিশেষ করে আমাদের পৌষ্টিকতন্ত্র, যথা খাদ্যনালী, পাকস্থলি, অন্ত্র ইত্যাদির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে। আমাদের হজম ক্ষমতাকে ভালো রাখার জন্য প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও স্ট্রেস কমাতে এবং ত্বককে সুন্দর রাখতেও সাহায্য করে।
প্রোবায়োটিকের ধরন
অনেক রকমের ব্যাকটেরিয়াকেই প্রোবায়োটিক বলা হয়। তবে প্রধানত দুই প্রকারের প্রোবায়োটিক আছে।
ল্যাকটোব্যাসিলাস :
এই প্রোবায়োটিকটি সবথেকে কমন। এটি সবথেকে বেশি পরিমানে দইতে পাওয়া যায় এছাড়াও যেকোনো গাঁজানো খাদ্যদ্রব্যে পাওয়া যায়। এটি ডায়রিয়া (উদরাময়) উপশম করতে সাহায্য করে এবং যেসমস্ত মানুষ দুধের শর্করা (lactose) হজম করতে পারেন না, তাদের জন্যও খুব উপকারী।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ল্যাকটোব্যাসিলাসের মাধ্যমে ইস্ট ইনফেকশন, ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস, ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম, ট্র্যাভেলার্স ডায়েরিয়া, অ্যান্টিবায়োটিকের ডায়েরিয়া, ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স, ত্বকের নানা সমস্যা, যেমন একজিমা, ব্রণ, জ্বরের ফোস্কা ইত্যাদি নিরাময়ে সাহায্য করে।
বিফিডোব্যাকটেরিয়াম :
বিভিন্ন ধরনের দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্যের ভেতর এই প্রোবায়োটিকটি পাওয়া যায়। কোলোনে থাকা সবথেকে ভালো ব্যাকটেরিয়া হল এটি। শিশুর জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই অন্ত্রে এই ব্যাকটেরিয়ার উপ্সথিতি দেখা যায়। এটি Irritable Bowel Syndrome (IBS) এর নিরাময়ে সাহায্য করে।
Saccharomyces boulardii হল এক ধরনের ইস্ট, যা প্রোবায়োটিকের ভেতর থাকে। এটি ডায়রিয়া ও অন্যান্য হজম সংক্রান্ত রোগের নিরাময়ে সাহায্য করে।
Streptococcus thermophilus দুধের শর্করা হজমে বিশেষ ভাবে সাহায্য করে।
Enterococcus faecium সাধারণ ভাবে মানুষ ও প্রানীর অন্ত্রে পাওয়া যায়।
প্রোবায়োটিকের কি কাজ
যেসমস্ত স্নায়ু আমাদের অন্ত্রের ভেতর দিয়ে খাদ্যের সঞ্চালনে সাহায্য করে, প্রোবায়োটিক সেইসব স্নায়ুকে প্রভাবিত করে। যেসমস্ত রোগগুলো প্রোবায়োটিকের প্রভাবে সেরে ওঠে সেগুলো হল—
- ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম
- ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (IBS)
- ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা প্যারাসাইটের কারণে হওয়া ইনফেকশাস ডায়েরিয়া
- অ্যাএন্টিবায়োটিকের কারণে হওয়া ডায়েরিয়া
- একজিমার মতো ত্বকের অসুখ
- মূত্র ও যোনি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান
- এ্যালার্জি ও ঠান্ডা লাগা রোধ করতে
- মুখগহ্বরের সুসাস্থ্য বজায় রাখতে
কি ভাবে গ্রহণ করতে হবে
সাধারণ ভাবে প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার ও ওষুধ নিরাপদ হয় এবং সবাই তা গ্রহন করতে পারেন, তবে যেসব মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা সংক্রান্ত রোগ আছে এবং অন্যান্য বড় রকমের অসুস্থতা আছে, তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রোবায়োটিক গ্রহন করার প্রথম কয়েকদিন কিছু হাল্কা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন, পেটে অস্বস্তি, পেট ফুলে থাকা, গ্যাস, ডায়েরিয়া ইত্যাদি হতে পারে। সমস্যা প্রকট হলে সাথে সাথে চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে।
প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাদ্য
১) দই : দই হল সবথেকে ভালো প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাদ্য। দুধ থেকে এটি তৈরি হয়। ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া ও বিফিডোব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে গাঁজানো হয় দুধকে। দই হাই ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং হাড়ের সুসাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার গলে শিশুদের যে ডায়েরিয়া হয়, তার উপশমে দই খুব ভালো কাজ করে এবং ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম কমানোয় বড় ভূমিকা পালন করে। ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স – এ ভোগা মানুষরা সহজেই দই হজম করতে পারেন, কারণ ব্যাকটেরিয়া ল্যাকটোজকে ল্যাকটিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত করে দেয়, ফলে দইয়ের স্বাদ টক হয়।
২) কেফির : কেফির হল প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ এবং দুধকে গাঁজিয়ে তৈরি করা একপ্রকার পানীয়। গরু বা ছাগলের দুধের সাথে কেফির দানা মিশিয়ে তৈরি করা হয় এটি। কেফিরের দানা ল্যাকটিক অ্যাসিড ও ইস্ট সমৃদ্ধ একপ্রকার দানা, যা অনেকটা ফুলকপির মতো দেখতে হয়। দইয়ের মতো কেফিরও প্রোবায়োটিকের একটি ভীষণ ভালো উৎস। ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স এর রোগীরা কেফির স্বচ্ছন্দে গ্রহন করতে পারেন। হাড়ের সুসাস্থ্য, হজমশক্তি বৃদ্ধি বিভিন্ন সংক্রমণ রুখতে কেফির সহায়তা করে।
৩) টেম্ফ : সয়াবিনকে গাঁজিয়ে এটি প্রস্তুত করা হয়। অনেকটা মাশরুমের মতো খেতে হয় এটি। প্রধানত ইন্দোনেশিয়ার খাদ্য হলেও সারা পৃথিবীতে মাংসের পরিবর্ত হিসাবে টেম্ফ ব্যবহার করা হয়। গাঁজানোর ফলে এতে ভিটামিন বি–১২ উৎপন্ন হয় ফলে নিরামিষাশীদের জন্য এটি অত্যন্ত উপযুক্ত প্রোবায়োটিক।
৪) ইডলি, দোসা : জিভে জল এনে দেওয়া এই দক্ষিন ভারতীয় খাবারটি চাল ও একপ্রকার ডাল কে গাঁজিয়ে তৈরি করা হয়। এতে খুব বেশি পরিমানে ভালো ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক) থাকে এবং লো ক্যালোরি হওয়ায় কারনে এটি খুব স্বাস্থ্যকর একটি খাদ্য।
৫) আচার : ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে আচারের নাম শুনে জিভে জল আসবে না এমন মানুষ খুব কম। এখানে নানা রকম ফল, সবজি দিয়ে আচার বানানো হয়, যেমন – আম, রসুন, লেবু, লঙ্কা, গাজর ইত্যাদি। আচার বানানোর জন্য ফল বা সবজিকে তেল, নুন বা অন্যান্য মশলা দিয়ে অনেকদিন ধরে জারিত করা হয়। আচার তাই ভালো ব্যাকটেরিয়ার (প্রোবায়োটিক) একটা বড় উৎস। শশার আচার প্রোবায়োটিকের ভীষণ ভালো একটা উৎস এবং এটি হজম ক্ষমতাকে ভালো রাখে। এছাড়া এই আচার ভিটামিন – কে সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। তবে এই ক্ষেত্রে ঘরে বানানো আচারই সবথেকে ভালো, বাইরে কিনতে পাওয়া আচারে অনেক কেমিক্যাল এর মিশ্রন করা জয়, ফলে তার ভেতর সেই ভালো ব্যাকটেরিয়া নষ্ট হয়ে যায়।
৬) ধোকলা : ধোকলা বানাতে প্রথমে বেসনকে গাঁজানো হয় এবং তারপর স্টিম করে তৈরি করা হয়। টাটকা এবং ভাজা নয়, এমন ধোকলা প্রোবায়োটিকের ভীষন ভালো উৎস। বেসনের তৈরি বলে এটি প্রোটিন সমৃদ্ধও হয়ে থাকে।
৭) ঘোল : এই দুগ্ধজাত পানীয়টি দই দিয়ে তৈরি করা হয়, ফলে এটি সম্পূর্ণটিই প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ। মাখন তৈরি করার পর যে তরল অংশটি পরে থাকে, তাকেই বাটারমিল্ক বলা হয়, এই অংশটি প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। ভারতবর্ষ, নেপালে এই পানীয়টির খুব প্রচলন আছে। এটিকে “Grandma’s Probiotic” ও বলা হয়ে থাকে। বাটারমিল্কে ফ্যাট ও ক্যালোরির পরিমান খুব কম থাকে এবং এটি ভিটামিন বি ১২, রাইবোফ্ল্যাবিন, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস সমৃদ্ধ হয়ে থাকে।