রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস একধরনের অটোইমিউন ডিজিজ, যা অস্থিসংযোগে যন্ত্রনার সাথে সাথে সমগ্র শরীরে সমস্যা তৈরি করে। সাধারণত শরীরের দুইদিকের অস্থিসংযোগই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে। এই কারনে চিকিৎসকরা অন্যান্য আর্থ্রাইটিসের সাথে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের পার্থক্য করতে পারেন। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর চিকিৎসা সবথেকে ভালো কাজ করে যদি একদম প্রথম দিকে চিকিৎসা শুরু হয় এবং তার জন্য রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর লক্ষণগুলো জানা খুব প্রয়োজনীয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর লক্ষণ
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হল ক্রনিক রোগ, যা অস্থিসংযোগের প্রদাহ ও যন্ত্রনার সৃষ্টি করে। এই লক্ষনগুলো যখন প্রকাশ পায়, সেই অবস্থাটা কে বলে Flares / Exacerbation এবং অন্য সময়টাকে বলা হয়, Remission — এই সময় রোগলক্ষন সম্পূর্ণ ভাবে চলে যায়।
যদিও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগলক্ষন সারা শরীরেই দেখতে পাওয়া যায়, তবে অস্থিসংযোগের ওপর এর প্রভাবগুলি হল—
- অস্থিসংযোগে যন্ত্রণা
- অস্থিসংযোগে প্রদাহ
- অস্থিসংযোগে ফোলাভাব ও আড়ষ্টতা
- অস্থিসংযোগের কর্মক্ষমতা চলে যাওয়া
এই রোগলক্ষনগুলি সামান্য দেখা গেলেও তৎক্ষনাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ।
রোগনির্নয়
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস নির্ণয়ে অনেক সময় লাগে এবং একাধিক ল্যাব টেস্টের প্রয়োজন হয়।
- অস্থিসংযোগের ফোলাভাব, লালভাব, স্টিফনেস পরীক্ষা করা হয়।
- মাংসপেশীর নড়াচড়ার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়
- এছাড়াও ব্লাডটেস্ট, আল্ট্রাসাউন্ড, MRI, এক্স–রে ইত্যাদি করা জয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর চিকিৎসা
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস কখনো পুরোপুরি সারে না, কিন্তু চিকিৎসার দ্বারা একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। Treat to Target Rheumatoid Arthritis হল বর্তমানে চিকিৎসার এমন এক ফিলোসফি, যা ব্যবহার করে রিউমাটোলজিস্টরা বেশ দক্ষতার সাথে এর চিকিৎসা করছেন। এই পদ্ধতিতে যতটা সম্ভব কম রোগলক্ষন এবং রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের যন্ত্রণা যত বেশি সম্ভব কম রাখার চেষ্টা করা হয়। এতে —
- কোনো নির্দিষ্ট টেস্টিং গোল নির্নয় করা হয়, যা থেকে বোঝা যায় রোগলক্ষন কম থাকছে কিনা
- অ্যাকিউট পর্যায়ে রোগের প্রকোপ ও চিকিৎসার প্রগতি বোঝার চেষ্টা করা হয়
- অগ্রগতি দেখা না গেলে চিকিৎসা পদ্ধতির দ্রুত পরিবর্তন করা
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের প্রধান চিকিৎসা হল যন্ত্রণা ও প্রদাহ কে নিয়ন্ত্রণে রাখা, এর ফলে অস্থিসংযোগ ও মাংস পেশি কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা হয়, সেগুলি হল—
- ওষুধ
- কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি
- খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন
- কিছু নির্দিষ্ট এক্সারসাইজ
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের ওষুধ
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসে যন্ত্রণা ও প্রদাহ কমানোর, অস্থিসংযোগের ক্ষতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ওষুধ দেওয়া হয়।
- ননস্টেরয়াডাল অ্যান্টিইনফ্লামেটরি ড্রাগস
- কর্টিকোস্টেরয়েড
- অ্যাসিটামিনোফেন
উপরিউক্ত ওষুধগুলো খুব সহজেই প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধের দোকানে পাওয়া যায় এবং এগুলি যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়াও যে ওষুধগুলো রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের ফলে হওয়া শারীরিক ক্ষতির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, সেগুলি হল—
- Disease-modifying antirheumatic drugs (DMARDs).— শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার সক্রিয়তা কে কমিয়ে রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস কে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- Biologics — এই ধরনের ওষুধ সমগ্র শরীরের ইমিউনিটি কে না কমিয়ে আক্রান্ত জায়গা তেই কেবলমাত্র প্রদাহকে নিয়ন্ত্রণ করে।
- Janus kinase (JAK) inhibitors. — এটিও DMARDs এর এক নতুন প্রকার যা শরীরের বিশেষ কিছু প্রতিরোধী ক্ষমতা কে নিয়ন্ত্রন করে রোগের প্রকোপ কে কম রাখার চেষ্টা করে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর ঘরোয়া চিকিৎসা
ব্যায়াম — লো ইমপ্যাক্ট এক্সারসাইজ, কিছু হাল্কা যোগা ইত্যাদির মাধ্যমে অস্থিসংযোগের আড়ষ্টভাব কমানো যায় এবং এক্সারসাইজ এর ফলে মাংস পেশির শক্তি বৃদ্ধি পায়।
পর্যাপ্ত পরিমানে বিশ্রাম — পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম এবং ঘুম যন্ত্রণা ও দুর্বলতা নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে
ঠান্ডা এবং গরম — কোল্ড কম্প্রেস বা বরফ মাংস পেশির ব্যথা ও প্রদাহ এবং হঠাৎ করে মাংস পেশির টান ধরা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। অপরদিকে হরম জলে স্নান এবং গরম সেঁক মাংস পেশির আড়ষ্টতা দূর করে।
খাদ্য
যেসব খাদ্যে প্রচুর পরিমানে ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আছে তেমন খাদ্য, যেমন—
- তৈলাক্ত মাছ
- চিয়া সিড
- ফ্ল্যাক্স সিড
- ওয়ালনাট
ভিটামিন এ,সি,ই ও সেলেনিয়াম,অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য, যেমন —
- বেরি
- ডার্ক চকোলেট
- রাজমা
- পালংশাক
- সয় প্রোডাক্ট
- গ্রিন টি
- ব্রকলি
- আঙুর
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস এর প্রকার
সেরোপজিটিভ RA : রক্তপরীক্ষায় পজিটিভ রিউমাটয়েড ফ্যাক্টর পাওয়া যাবে, অর্থাৎ এমন অ্যান্টিবডির খোঁজ পাওয়া যাবে যা ইমিউনিটি সিস্টেম কে বাধ্য করছে অস্থি সংযোগকে আক্রমণ করতে।
সেরোনেগেটিভ RA: যদি নেগেটিভ RF ব্লাড টেস্ট, নেগেটিভ Anti CCP রেসাল্ট থাকে এবং তারই সাথে রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস এর লক্ষন থাকে, তাহলে এটি সেরোনেগেটিভ RA
জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থারাইটিস : ১৭ বছর বা তার নীচের বাচ্চাদের এই আর্থারাইটিস হয়ে থাকে, এতে অন্যান্য রোগলক্ষন এক হলেও এটি বৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলে এবং চোখে প্রদাহ দেখা যায়।
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের কারন
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের সঠিক কারন এখনো অজানা, তবে যে যে কারনগুলিকে এর জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়, সেগুলি হল—
- আপনি একজন নারী হলে
- পরিবারে রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের ইতিহাস থাকলে
- পেরিয়ডোন্টাল ডিজিজ বা ওই ধরনের কোনো রোগ ও ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা আক্রান্ত হলে রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়
- ভাইরাস সংক্রমণের ইতিহাস, যেমন Epstein — Barr ভাইরাসে আক্রান্ত হলে mononucleosis তৈরি হয়
- যেকোনো ধরনের আঘাত, যেমন হাড় ভেঙে যাওয়া, জয়েন্ট ডিসলোকেট হওয়া, লিগামেন্ট ইনজুরি ইত্যাদি হলে ভবিষ্যতে রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
- সিগারেট স্মোকিং
- ওবেসিটি
হাতে রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস
হাতে রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস হলে প্রথম প্রথম দিনের শেষে একটা জ্বালার অনুভূতি হয়, আস্তে আস্তে যন্ত্রণা শুরু হয় এবং এর চিকিৎসা না করলে মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে
- ফুলে যাওয়া
- লাল হয়ে যাওয়া
- গরম হয়ে যাওয়া
- পেশির শক্ত ভাব — এগুলোও দেখা যায়।
রোগ যত বাড়তে থাকে তত কবজি, হাঁটু, গোড়ালিতে সাইনোভিয়াল সিস্ট দেখতে পাওয়া যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেন্ডনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আক্রান্ত অস্থি সংযোগে bone spurs তৈরি হয় যার ফলে হাত আর কর্মক্ষম থাকে না।
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস কি বংশগত ?
রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস বংশগত রোগ নয়, যদিও এটি একই বংশের বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে দেখা যায়। প্রাকৃতিক কারন, বংশগতি বা এই দুইয়ের মিশ্রণ ই এই রোগের কারন হতে পারে। যদি আপনার পরিবারের কারোর রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস থাকে এবং আপনার হাতে পায়ে যন্ত্রনা, অস্থিসংযোগে আড়ষ্টতা, ফোলা ভাব, লাল ভাব ইত্যাদি থাকে তাহলে দেরী না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।