সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে মুক্তির উপায় কী সেই ধারণা প্রায় সবারই। ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটির মতো সমস্যা গুলি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে গুরুত্ব পেলেও, আড়ালে থেকে যাচ্ছে সিজোফ্রেনিয়া নামক এই ভয়ানক মানসিক রোগ।এমনিতেই আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষই মানসিক সমস্যাকে সাধারণত তেমন গুরুত্ব দিতে চান না। আর এই কারণেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানসিক রোগের চিকিৎসা শুরু হয় একেবারে প্রায় শেষ মুহূর্তে। আর তখন পরিস্থিতি একরকম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শেষ পাওয়া পরিসংখ্যান (২০১৭ সাল) অনুযায়ী, বর্তমানে গোটা বিশ্বে ২ কোটির বেশি মানুষ শুধুমাত্র সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত। যাদের বেশীরভাগই মূলত অবহেলার শিকার। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষ সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত। সাধারণ মানুষের গড় আয়ুর তুলনায়, সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্তদের আয়ু প্রায় ১৫-২০ বছর কম হয়। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হলে তাঁর মৃত্যু সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক আগে হয়। ২০-৪৫ বছর বয়সের কিশোর, কিশোরী, যুবক, যুবতী, পুরুষ,মহিলা, যে কোনো কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই উচিত মনরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে সামান্য অবহেলাও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
সিজোফ্রেনিয়া কী?
সিজোফ্রেনিয়া আসলে একপ্রকার জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ব্যাধি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তা ভাবনা এবং অনুভূতির প্রকাশের মধ্যে কোনোপ্রকার সঙ্গতি থাকে না ৷ রোগী বাস্তব বোধ এবং উপলব্ধি হারিয়ে ফেলেন, এবং প্রায়ই হ্যালুসিনেশনে ভোগেন। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিকভাবে বা কর্মক্ষেত্রে অক্ষমতা জনিত অসুবিধার সম্মুখীন হন ৷
এটি শৈশব বা কৈশোরের শেষের দিকে দেখা যায়। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের আজীবন এই রোগের সাথে লড়াই করতে হতে পারে। এই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এমন শব্দ এবং কণ্ঠস্বর শুনতে পান যা বাস্তবে নেই।
সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা মনে করেন অন্যরা তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বা তাদের মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। সিজোফ্রেনিক রোগীরা প্রায়শই নিজেকে পীড়িত, ব্যথিত মনে করেন। এমনকি মাঝে মাঝে ধর্মান্ধ হয়ে পড়েন।
সিজোফ্রেনিক রোগীদের সাথে যাঁরা সবসময় থাকেন, তাঁদেরও প্রায়শই বুঝতে অসুবিধা হয় যে রোগী ঠিক কী নিয়ে কথা বলছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো সিজোফ্রেনিক রোগী দিনের পর দিন একটা কথাও না বলে, সম্পূর্ণ স্থির হয়ে থাকেন ৷
সিজোফ্রেনিয়া এমন এক ব্যাধি যা শুধু রোগীকেই নয়, তার সাথে তাদের পরিবার, বন্ধু এবং সমাজকেও প্রভাবিত করে। অধিকাংশ সিজোফ্রেনিক রোগীকেই তাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য অন্যদের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই রোগীরা চিকিৎসা করাতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। কারণ তাঁরা মনে করেন যে তারা স্বাভাবিক ৷
সিজোফ্রেনিয়া-র প্রকারভেদ
প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া
প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির নির্দিষ্ট কিছু ভ্রান্ত ধারণা বা বিভ্রান্তি থাকে। এমন কিছু হ্যালুসিনেশন তাঁদের হয়, যার সাথে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত মনে করেন যে, কোনও ব্যক্তি বা তার আশেপাশের মানুষেরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে ৷
হেবিফ্রেনিক সিজোফ্রেনিয়া
হেবিফ্রেনিক সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা অগোছালো চিন্তাভাবনার সাথে সাথে বিশৃঙ্খল আচরণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি অসংলগ্ন এবং অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা মনের মধ্যে পোষণ করেন। দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ যেমন রান্না করা, খাওয়া, নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া ইত্যাদি সসম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না এই রোগীরা।
ক্যাটাটনিক সিজোফ্রেনিয়া
এক্ষেত্রে আক্রান্ত রোগী শারীরিকভাবে অদ্ভুত আচরণ করতে পারেন, যেমন হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে পড়া। এক্ষেত্রে রোগীর পেশি চালনার ভঙ্গিও অস্বাভাবিক হয়। যেমন, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে যাওয়া, চুপচাপ হয়ে অদ্ভুত ভাবে বসে থাকা, সামনের মানুষটা যা বলছে তা বারবার বলা, ইত্যাদি।
আনডিফারেন্সিয়েটেড সিজোফ্রেনিয়া
এই জাতীয় সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে একাধিক ধরনের সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ গুলি দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, এমন একজন ব্যক্তি যার মধ্যে ক্যাটাটনিক সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ বর্তমান, কিন্তু তার সাথে সেই ব্যক্তির মধ্যে বিভ্রান্তি বা হ্যালুসিনেশনও বর্তমান।
রেসিডুয়াল সিজোফ্রেনিয়া
এক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলি তেমন গুরুতর হয় না। অর্থাৎ তাদের উপসর্গ গুলির মধ্যে উগ্রতা থাকে না। যেমন- নিম্নমানের স্বাস্থ্যবিধি, ধীরে কথা বলা, সাইকোমোটর ডিলিকাল্টিজ এবং অন্যান্য ছোটখাটো শারীরিক ও মানসিক সমস্যা।
সিজোফ্রেনিয়া-র লক্ষণ
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তই রোগীদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়, তা হল
• হ্যালুসিনেশন, অবাস্তব চিন্তাভাবনা, ভ্রান্ত ধারণা।
• অকারণ সন্দেহ, বিড়ম্বনা, বিভ্রান্তি ইত্যাদি।
তবে মনে রাখতে হবে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত সব রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষণ এক রকম হয় না। লক্ষণ বা উপসর্গ গুলি রোগীর ওপরেই সাধারণত নির্ভর করে। কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণগুলি কয়েক মাস বা কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। বা হঠাৎ করেও দেখা দিতে পারে। যেমন —
• গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে উদাসীন থাকা।
• এমন কিছু শুনতে বা দেখতে পাওয়া যার বাস্তবে কোনো ভিত্তিই নেই।
• অযৌক্তিক রাগ, ক্ষোভ বা চারপাশের মানুষদের প্রতি ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া।
• কথা বলা বা লেখায় অদ্ভুত এবং অযৌক্তিক ধরন ও আচরণ।
• ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি এবং চেহারায় নিম্নমানের পরিবর্তন ৷
• অনুপযুক্ত আচরণ।
• পড়াশুনায় বা অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে অমনোযোগী থাকা এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অদ্ভুত পরিবর্তন।
• বাস্তবজগত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। কারও কারও ক্ষেত্রে কথাবার্তায় প্রথম থেকেই অস্বাভাবিকতা ও বাস্তববিমুখী হওয়ার পরিচয় পাওয়া যায়।
• হ্যালুসিনেশন
এক্ষেত্রে রোগী এমন কিছু দেখতে পান বা অনুভব করেন, এমনকি স্বাদ গ্রহণ, শ্রবণ বা গন্ধ পাওয়ার ক্ষেত্রেও বাস্তবে যার আসলেই কোনও অস্তিত্ব নেই।
• ডিলিউশন
এমত অবস্থা দেখা দিলে, আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত ভুল ধারণা বা বিশ্বাস মনের মধ্যে বহন করেন, যার সাথে বাস্তবের কোনও মিল থাকে না। তাদের শুধু মনে হয় কেউ তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।
•বিশৃঙ্খল আচরণ
এক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে তাঁর স্বাভাবিক আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- সব কিছু ভুলে যাওয়া, খুব দ্রুত চিন্তাধারা বদলানো, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা, কোনো শব্দ বা অনুভূতি ঠিক মতো বুঝতে না পারা, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির পুনরাবৃত্তি করা, ইত্যাদি।
•অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা এবং কথাবার্তা
এক্ষেত্রে রোগী আকস্মিকভাবে হঠাৎ করেই একটি বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে চলে যায়। বারবার কোনও কথা, শব্দ বা ছড়া পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন।
সিজোফ্রেনিয়া-র কারণ
বহু মানসিক বা স্নায়বিক রোগের মতো সিজোফ্রেনিয়ার সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে, যে যে কারণগুলিকে এই রোগের জন্য সাধারণত দায়ী করা হয়, সেগুলি হল —
• জেনেটিক বা বংশগত ভাবে কারও এই রোগ থাকলে তা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও দেখা দিতে পারে। তবে বাবা, মা-র মধ্যে কারোও এই রোগ থাকলে সন্তানের তাতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
• মস্তিষ্কের কোনো রাসায়নিক উপাদানের ত্রুটি এবং নিউরোকেমিক্যাল উপাদান গুলির কোনও ঘাটতি হলেও এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
• শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে বাসা বাঁধতে পারে এই রোগ।
• গর্ভাবস্থায় মা যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তখন সেক্ষেত্রে সন্তানের মধ্যেও দেখা দিতে পারে এই রোগ।
• জন্মকালীন কোনও জটিলতা থাকলেও পরবর্তীতে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
• মানসিকভাবে অত্যন্ত চাপের মধ্যে দীর্ঘদিন থাকলেও সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
• কিছু উত্তেজক মাদকদ্রব্য এবং স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ এই রোগের কারণ।
সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে মুক্তির উপায়- চিকিৎসা
মনে রাখতে হবে, এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ গুলি দেখা দিলেই চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
- এই চিকিৎসার সাধারণত যে ওষুধ প্রয়োগ করা হয় তা হলো অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগ। হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন এবং সাইকোসিসের লক্ষণ গুলি প্রশমিত করতে ওষুধের ব্যবহার করা হয়।
- এর পাশাপাশি সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ বিভিন্ন থেরাপি ও মনোচিকিৎসাও গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর সামাজিক সহায়তাও ভীষণ ভাবে প্রয়োজন হয়।
- সাইকোলজিক্যাল ইন্টারভেনশন থেরাপি-র মাধ্যমে রোগী স্ট্রেস এবং অন্যান্য মানসিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি লাভ করে।
- ভোকেশনাল রিহ্যাবিলিটেশন এর মাধ্যমে রোগীকে কাজে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷
- এছাড়াও, রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া করে মাথায় ইলেকট্রোড লাগানো হয় এবং তারপর ছোটো কারেন্টের শক দেওয়া হয়। এতে রোগীর মানসিক অবস্থা এবং চিন্তাশক্তির উন্নতি হয়।