আমাদের দেশে বছরে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এই বিপুল সংখ্যক জনগণের মধ্যে ৭০ শতাংশ ব্যক্তি পক্ষাঘাতের শিকার হন। সুতরাং স্ট্রোক অত্যন্ত গুরুতর একটি অসুখ এবং স্ট্রোক নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। সবচাইতে বড় কথা সামান্য সচেতন হলেই ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আমাদের মস্তিষ্ক চারটি অংশে বিভক্ত— ফ্রন্টাল লোব, প্যারাইটাল লোব, টেম্পোরাল লোব এবং অপটিকাল লোব। ফ্রন্টাল লোব ভাবনা চিন্তা, বিচার করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আচার ব্যবহার, শব্দ উৎপাদনের কাজ করে। স্মৃতিশক্তি ধরে রাখা, শব্দের অর্থ বোঝার মতো কাজ করে টেম্পোরাল লোব। স্পর্শ বোঝা, তথ্যের বিশ্লেষণ ইত্যাদি কাজগুলি করে প্যারালাইট লোব। চোখের দৃষ্টি বিশ্লেষণ করে অপটিকাল লোব।
মস্তিষ্কের প্রতিটি অংশ সঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজন হয় রক্তের। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণে অক্সিজেন এবং গ্লুকোজ পৌঁছে দেয় রক্ত। এভাবেই মস্তিষ্ক তার কাজ চালিয়ে যায়। এখন কোনও কারণে রক্ত সঞ্চালন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে বা রক্তের প্রবাহে বাধা তৈরি হলে মস্তিষ্ক তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারবে না। এই ঘটনাকেই বলে স্ট্রোক। অতএব বোঝাই যাচ্ছে মস্তিষ্কের কোনও অংশে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হলে ক্রমশ সেই জায়গার স্নায়ু কোষগুলি আর কাজ করতে পারবে না। শরীরে দেখা দেবে নানা সমস্যা।
স্ট্রোকের প্রকারভেদ
স্ট্রোক হতে পারে দুই ধরনের— ইস্কিমিক স্ট্রোক এবং হেমারেজিক স্ট্রোক। ইস্কিমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ব্রেনের রক্তবাহী নালীতে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার ফলে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়। অন্যদিকে হেমারেজিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালী ছিঁড়ে গিয়ে ব্রেনে রক্তক্ষরণ হয়। যেখানে রক্তক্ষরণ হয়, সেই অংশের স্নায়ু কোষগুলি নষ্ট হয়ে যায়।
মিনি স্ট্রোক
অনেক সময় আমাদের ব্রেনে ছোট ছোট স্ট্রোক হয়। ফলে শরীরে যে লক্ষণগুলি দেখা দেয় তা মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। রোগী কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যান। এই জাতীয় স্ট্রোককে ট্রানজিয়েন্ট ইস্কিমিক অ্যাটাক বা ‘মিনি স্ট্রোক’ বলে। ট্রানজিয়েন্ট ইস্কিমিক অ্যাটাক হলে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। দেখা গিয়েছে ট্রানজিয়েন্ট ইস্কিমিক অ্যাটাকের কয়েকদিন পরে বড় ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হন রোগী।
স্ট্রোকের কারণ
স্ট্রোকের প্রধান কারণ হল হাই ব্লাড প্রেশার। অন্য কারণগুলো হল অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, রক্তে এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরলের বেশি মাত্রা, হার্টের অসুখ, স্থূলত্ব, অলস জীবনযাপন, স্ট্রেস, পরিবারে স্ট্রোকের ইতিহাস, ধূমপান সহ তামাক সেবন, মদ্যপানের অভ্যেস ইত্যাদি বিষয়।
স্ট্রোকের লক্ষণ
১) হঠাৎ শরীরের একদিক অবশ হয়ে যেতে পারে।
২) হঠাৎ ঠোঁট বেঁকে যাওয় কথা আটকে যাওয়া।
৩) হঠাৎ অদ্ভুত আচরণ করা।
৪) কিছু কিছু রোগী হঠাৎ একচোখে দেখতে পান না। কেউ কেউ আবার একটি বস্তুকে পাশাপাশি দেখেন।
৫) মাথা ঘুরতে পারে।
৬) কেউ কেউ ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যান।
৭) রক্তক্ষরণের কারণে মাথায় তীব্র ব্যথা হতে পারে।
৮) রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।
স্ট্রোকের চিকিৎসা
স্ট্রোক হয়েছে বুঝলে দেরি করবেন না। সাধারণত স্ট্রোক হওয়ার পরে ১ থেকে ৪ চার ঘণ্টা সময়কে বলা হয় গোল্ডেন আওয়ার। তাই কোনও ব্যক্তির স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত বড় হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। সেখানে রোগীর সিটি স্ক্যান হবে ও সমস্যা দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে। এছাড়া প্রয়োজন বুঝলে চিকিৎসক এমআরআই, ডপলার আলট্রাসাউন্ড টেস্ট করাতে পারেন। কারও কারও হলটার মনিটরিং করারও প্রয়োজন হয়। ইস্কিমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ব্রেনের রক্ত প্রবাহ পুনরায় স্বাভাবিক করার জন্য টিস্যু প্লাসমিনোজেন অ্যাক্টিভেটর ইঞ্জেকশন দেওয়া হতে পারে। ইঞ্জেকশনে কাজ না হলে ব্রেনে স্টেন্ট পরিয়ে ক্লট খুলে দেওয়া যেতে পারে। হেমারেজিক স্ট্রোকের চিকিৎসায় প্রথমেই নিয়ন্ত্রণে আনতে হয় রক্তচাপ। অনেকসময় রোগীকে ভেন্টিলেটরেও দিতে হতে পারে। এছাড়া রোগীর ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের মতো রোগগুলির সঠিক চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। দরকার পড়লে অপারেশন করে রক্ত বের করে দিতে হয়।
স্ট্রোক কিভাবে প্রতিরোধ করবেন ?
• রক্তচাপ থাকতে হবে ব্লাড প্রেশার ১২০/৮০ এমএম এইচজি।
• ডায়াবেটিস থাকলে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি।
• শরীরে কোলেস্টেররে মাত্রা বেশি থাকলেও তা আনতে হবে নিয়ন্ত্রণে।
• নিয়মিত শরীরচর্চা করে ওজন আনতে হবে নিয়ন্ত্রণে।
• পাঁঠার মাংস বা ওই জাতীয় বড় প্রাণীর মাংস খাওয়া যাবে না।
• ডিমের কুসুম, মিষ্টি, তেল, ঘি খাওয়া যাবে না।
• তামাকজাত দ্রব্যের নেশা ছাড়তেই হবে।
• হার্টের অসুখ থাকলে, আগে স্ট্রোক বা টিআইএ হয়ে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খেয়ে যেতে হবে।
স্ট্রোক হলে কী খাবেন ?
শাকসব্জি বেশি খাওয়া প্রয়োজন। আর সম্ভব হলে প্রতিদিন খেতে হবে মরশুমি ফল।