বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে আকস্মিক মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ (SCD) অথবা সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (SCA)। বলা ভালো, সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (SCA) কারণ হলে, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ তার ফলাফল। এই জাতীয় মৃত্যু এতটাই নাটকীয় ভাবে ঘটে যে আশপাশের মানুষগুলির বিহ্বলতা কাটিয়ে কোনো ব্যবস্থা করে উঠবার আগেই আমরা সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত মানুষটিকে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে ফেলি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় চিকিৎসার নূন্যতম সময় টুকুও। ২০২১ সালের ইউরো কাপ চলাকালীন খেলার মাঠেই ডেনমার্কের ফুটবলার এরিকসনও SCA তে আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ কিন্তু ডাক্তার ও প্যারামেডিকদের পারদর্শিতায় তিনি শেষ পর্যন্ত জীবন ফিরে পান।
বেসিক লাইফ সার্পোট (BLS) বা CPR (Cardiopulmonary resuscitation) পদ্ধতিতে এরিকসনের হৃদযন্ত্র আবার সচল হয়েছিল। মৃত্যুকে হারিয়ে জীবন ফিরে পেয়েছিলেন তিনি৷ সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের এক নির্মম মুহূর্তের।
এছাড়াও, নানা গবেষণায় দেখা গেছে যে কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে SCA হবার প্রবণতা অনেকটাই বেশী।
সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (SCA) এবং সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ (SCD) এর পরিসংখ্যান কী বলে?
উঃ শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে অর্ধেকেরও বেশী হার্টের অসুখের পরিণতি হয় সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ (SCD)। আর ২০১৯ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতবর্ষে ১০% মৃত্যুই সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ফলে হয়। দেখা গেছে হাসপাতালের বাইরে SCA এর যে ঘটনাগুলি ঘটে, তার মধ্যে ৮০ শতাংশ ঘটে বাড়িতে এবং ২০ শতাংশ কোনো জনবহুল পরিবেশে (এয়ারপোর্ট, শপিং মল)। SCA হবার পাঁচ মিনিট পরে আক্রান্তের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগ কমে যায়। সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়া মাত্রই হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়না৷ বরং SCA হওয়ার ৩-৫ মিনিট পর্যন্ত ৩৫০-৪০০ বিপিএম হারে অতি দ্রুত গতিতে হৃদস্পন্দন হয়। আর তারপরেই একসময় তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়৷ ফলে সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ হয়। যদিও SCA এর চার মিনিটের পর থেকেই আক্রান্তের মস্তিষ্কে ক্ষতিকারক পরিবর্তন শুরু হয়। আর পাঁচ থেকে ছ’মিনিট পরে প্রাণ ফিরে পাবার আশা আর থাকেনা বললেই চলে। তাই যা কিছু করবার তা প্রথম দু-তিন মিনিটেই করতে হবে; এবং সেই কাজটি করতে পারবেন একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি৷ তিনি BLS এর মাধ্যমে আক্রান্তের হৃদযন্ত্র আবার সচল করতে তুলতে পারবেন। তাই SCD প্রতিরোধে ডাক্তারের চেয়েও বড় ভূমিকা সমাজের, এবং অবশ্যই সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সচেতনতার।
সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (SCA) এর উপসর্গ গুলি কী কী?
উঃ হঠাৎ করে পড়ে যাওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনির মত হওয়া, স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্টবোধ অথবা ধীরে ধীরে শরীর নীল হয়ে যাওয়া — সাধারণত এগুলিই SCA এর উপসর্গ হিসেবে দেখা যায়৷
হার্ট অ্যাটাক এবং সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কি এক?
উঃ একেবারেই নয়। করোনারী ধমনীতে চর্বি জমে রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ার ফলে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে, এবং তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। আর SCA এর ক্ষেত্রে হৃৎস্পন্দনের গতি দ্রুত ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে এবং সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। SCD এর একটি কারণ অবশ্যই SCA, তবে আরও বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম হলো হার্ট অ্যাটাক। অর্থাৎ হার্ট অ্যাটাকের ফলেও সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ হয়৷
বেসিক লাইফ সার্পোট (BLS) কী?
উঃ কোনো ব্যক্তি SCA তে আক্রান্ত হলে, স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার একটি তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পদ্ধতি হলো BLS, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যেটি আয়ত্ত করা এবং সময় মতো সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা দেশের প্রতিটি দায়িত্ববান নাগরিকের কাছে অবশ্য কর্তব্য। BLS এর ধাপগুলি খুব কঠিন নয়। প্রয়োজন সঠিক প্রয়োগ। প্রথমত নিজেকে ও আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসা, এবং তারপর মানুষটির সাথে কথা বলে বা তার শ্বাস প্রশ্বাসের ধরণ লক্ষ্য করে তার মধ্যে প্রাণ আছে কিনা বা কি অবস্থায় আছেন তা লক্ষ্য করা।
যদি তিনি নিষ্প্রাণ হন, তবে আশে পাশে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং BLS ধাপে ধাপে প্রয়োগ করা। নিজের মুখ রোগীর মুখের কাছে এনে, নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শ্বাসবায়ু নির্গমন আর নিজের দুটি হাত একসাথে করে আক্রান্তের বুকের পাঁজরের নিচের দিকে নির্দিষ্ট রীতি মেনে পর্যায়ক্রমে ম্যাসাজ করা। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের সচেতনতার কথা ভাবলে অনেকেই হয়তো মুখের কাছে এসে নিঃশ্বাস বায়ু দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না, বিশেষতঃ কোভিড পরবর্তী সময়ে। তাই সকলের গ্রহণযোগ্যতার কথা মাথায় রেখেই শুধুমাত্র কার্ডিয়াক ম্যাসজ (Compresion of life repport) সবার জন্য শিক্ষণীয় পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
আমাদের দেশে SCA সম্বন্ধে মানুষ কতটা সচেতন ? BLS সম্বন্ধে ধারণাটাই বা কতটুকু আছে?
উঃ SCA এ আক্রান্ত কোন নাগরিককে BLS দিতে এগিয়ে আসার জন্যে যে সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা বা সাধারণ জ্ঞান দরকার, তার কোনটাই আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এখনও নেই। যে দেশের অধিকাংশ মানুষ মধ্য বা নিম্ন আর্থ সামাজিক স্তরের, তাদের কাছে BLS প্রশিক্ষণ নিতে এগিয়ে আসার ভাবনা হয়তো কিছুটা বিলাসিতাই। অধিকাংশ পাশ্চাত্য দেশগুলির মত আমাদের দেশেও BLS প্রশিক্ষণ, স্কুল কলেজের সিলেবাসে বাধ্যতামূলক করা উচিত। যেসব আধিকারিকরা জনবহুল এলাকায় কাজ করেন, তাদেরও BLS প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত (যেমনঃ শপিং মল, এয়ার পোর্ট, রেল স্টেশন, খেলার মাঠ ইত্যাদি)। প্রতিটি দায়িত্বশীল পরিবারের অন্তত একজন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যের BLS পদ্ধতি শেখা উচিত। কারণ অধিকাংশ SCA বাড়িতে রাত বিরেতে ঘটে যখন বাইরের কারো থেকে তৎক্ষণাৎ সাহায্যের আশা একেবারেই করা যায় না।
BLS প্রদানকারীদের কী কী বিশেষ গুণাবলী থাকা উচিত? সরকারই বা তাদের প্রতি কতটা দায়িত্বশীল?
উঃ BLS পদ্ধতি শেখার জন্য চাই সঠিক প্রশিক্ষণ এবং নির্দিষ্ট সময়ে প্রশিক্ষণের পুনর্নবীকরণ। BLS প্রদান করতে যথেষ্ট শারীরিক সক্ষমতার প্রয়োজন এবং যতক্ষণ না আক্রান্ত ব্যাক্তি জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন অথবা সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ BLS চালিয়ে যাওয়া উচিত। মানসিক দিক থেকে BLS প্রদানকারীকে যথেষ্ট দৃঢ় হতে হবে। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, এমনকি আক্রান্ত ব্যাক্তির মৃত্যু হলে তাকে দায়ী করাও হতে পারে। স্থানীয় থানা এবং হাসপাতালের আধিকারিকদের কাছেও অনেক হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তাই BLS প্রদানকারীর মহৎ উদ্দেশ্যকে সম্মান জানাতে আজ বহু রাজ্যের সরকারই এগিয়ে এসেছে। Good Samaritan Policy বলে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যার ফলে BLS প্রদানকারীকে যেন তাঁর এই মহৎ কাজের শেষে কোন রকম হেনস্থার সম্মুখীন হতে না হয়, এবং তাঁর মহৎ প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানিয়ে কিছু আর্থিক পুরস্কারও তাকে দেওয়া হবে।
সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ প্রতিরোধে AED ও ICD র ভূমিকা কি?
উঃ পাশ্চাত্য দেশগুলিতে যে কোন জনবহুল জায়গায় AED (Automated External Defibrillators) বলে একটি যন্ত্র থাকে, যার মধ্যে উপস্থিত দুটি প্যাডের সাহায্যে সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয় এবং তৎক্ষণাৎ হার্টের গতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। আমাদের দেশেও এয়ারপোর্ট, রেল স্টেশন, শপিংমল প্রভৃতি জায়গা গুলিতে AED বসানো উচিত। আর ICD (Implantable Cardiac Defibrillators) একটি বিশেষ ধরণের পেসপেকার যা শরীরের ভেতর থেকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে হার্টের অনিয়ন্ত্রিত গতি বা SCA কে প্রতিরোধ করে।
সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট প্রতিরোধে বিভিন্ন সংগঠন গুলির ভূমিকা কি?
উঃ যেহেতু নিজের জীবন ও পেশার মধ্যগগনে থাকা মানুষগুলিই SCA তে সর্বাধিক আক্রান্ত হয়, তাই আর্থসামাজিক স্তরে এর প্রভাব সুদূর প্রসারী। যেহেতু এর প্রতিরোধে সচেতনতা একেবারেই তলানিতে, তাই মেডিকেল কলেজের গুটিকয়েক ভূতপূর্ব চিকিৎসক ‘ভেগাস’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সূচনা করেন। যাদের কাজ হলো সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষগুলির কাছে SCA সম্বন্ধে সচেতনতা পৌছে দেওয়া। একথা সত্যি যে আজও এই সমাজে একজন অচেনা মানুষ যদি কোন পথচারীকে BLS দিতে এগিয়ে আসেন, তাহলে তা অধিকাংশ মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই যারা সমাজের রক্ষক, অর্থাৎ ডাক্তাররা যদি BLS প্রশিক্ষণে এগিয়ে আসেন, তাহলে সমাজের ওপর তার গুরুত্বই অপরিসীম। কলকাতা ট্রাফিক পুলিশ এ ব্যাপারে সবাইকে পথ দেখিয়েছেন। এ ব্যাপারে বর্তমান জয়েন্ট সি পি ট্রাফিক, মিঃ সন্তোস পান্ডে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ওঁর উদ্যোগে কলকাতার ট্রাফিক ট্রেনিং স্কুলে ভেগাস এর সদস্যেরা BLS প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। আনুমানিক ৬০ জন ট্রাফিক সার্জেন্টকে এখনও পর্যন্ত প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
একথা ঠিক যে একদিনের প্রশিক্ষণে পারদর্শী তৈরী করা যায় না। কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে যদি সচেতনতা তৈরী করা যায়, তাহলে কিছুটা হলেও এর প্রতিরোধ সম্ভব। Protect the warriors বলে একটি চিকিৎসকদের সংগঠন তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বহু সরকারী এবং বেসরকারী সংগঠন Critical care society of India, Indian Society of Anaesthesiology তাদের মত করে কাজ করে চলেছেন।
সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট প্রতিরোধে সমস্ত উদ্যোগই হয়েছে সাময়িক ও ক্ষুদ্র আঙ্গিকে। তাই আজ প্রয়োজন এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। একদিকে BLS প্রশিক্ষণকে স্কুল/কলেজের পাঠক্রমে বাধ্যতামূলক ভাবে অন্তর্ভূক্ত করা, অন্যদিকে সমাজের দায়িত্ববান নাগরিকদের জন্যে সুপরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদী BLS প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা- কে জানে হয়তো এই BLS প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই এই সমাজ আবার ভালবাসা, মৈত্রী ও মানবিকতার বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
সৌজন্যে – ডাঃ শঙ্খ শুভ্র দাস