রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস কী?
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হল জয়েন্টের একধরনের প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন। অসুখটি দীর্ঘস্থায়ী। প্রদাহের কারণে জয়েন্টের ক্ষয় হয় ও বাধা না দিলে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। ফলে অস্থিসন্ধিগুলির সচলতা এবং নমনীয়তা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। জয়েন্ট ভাঁজ করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। চিকিৎসা না করালে একসময় রোগীর পক্ষে হাত মুঠো করা বা হাত-পা নাড়ানো অসম্ভব হয়ে যায়। জয়েন্ট ফুলে যায়। ব্যথা হয়। সময়ে চিকিৎসা না করালে পরবর্তীকালে জয়েন্ট বেঁকেও যেতে পারে।
শরীরের কোন কোন অংশে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হয় ?
শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধিগুলিতে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস আক্রমণ করতে পারে। প্রাথমিক দিকে হাত ও পায়ের ছোট ছোট জয়েন্টগুলি আক্রান্ত হয়। এরপর বড় বড় জয়েন্টগুলি আক্রান্ত হতে শুরু করে। উদাহরণ হিসেবে হাঁটু, গোড়ালি, কাঁধ, কনুইয়ের কথা বলা যায়। এমনকী দেখা গিয়েছে মেরুদণ্ডের সার্ভাইক্যাল অংশে আটলান্টো-অ্যাক্সিয়াল জয়েন্টেও আক্রান্ত হতে পারে।
পরিসংখ্যান
আমাদের দেশে প্রায় ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষ রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন। এই সমস্যায় আক্রান্তদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে বিরাট সমস্যা হয়। অথচ এই অসুখের ভালো চিকিৎসা রয়েছে। চিকিৎসা করালে রোগী তার রোজকার কর্মে যোগদান করতে পারেন। জীবনও আগের মতো স্বাভাবিক পরিচালনা করতে পারেন।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগের লক্ষণ
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হল প্রদাহজনিত অসুখ। শরীরে কোনও অঙ্গে প্রদাহ হলে মূলত তিনটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়—
১) ব্যথা, ২) ফোলা এবং ৩) লালভাব।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস একটি অটো-ইমিউন অসুখ। অর্থাৎ দেহের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা ভুল করে অস্থিসন্ধিগুলিকে আক্রমণ করে বসে। তাই এই অসুখকে আগাম চিনতে পারলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায় ও রোগের অগ্রগতিও রোধ করা সম্ভব হয়।
আগাম লক্ষণ কি ?
ইনফ্ল্যামেটরি আর্থ্রাইটিসের এক বিশেষ ধরনের শারীরিক উপসর্গ থাকে যা এই অসুখকে দ্রুত
চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এই উপসর্গের নাম আর্লি মর্নিং স্টিফনেস।
আর্লি মর্নিং স্টিফনেস কী?
রোগী সকালবেলায় ঘুম থেকে ওঠার পর অনুভব করেন যে তাঁর হাত ও পায়ের জয়েন্টগুলি আড়ষ্ট হয়ে আছে। ফলে রোগীর পক্ষে বিছানা থেকে উঠে হাঁটতে প্রবল সমস্যা হয়। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর হাত ও পায়ের জয়েন্টগুলি ক্রমশ নমনীয় হতে থাকে। ব্যথাও কমতে থাকে। এই অবস্থা একঘণ্টারও বেশি সময় ধরে স্থায়ী হতে পারে। এই ধরনের সমস্যা ১ মাস বা তার বেশি সময় ধরে স্থায়ী থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা না হলে কী কী জটিলতা দেখা যায় রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ?
চিকিৎসা না হলে অস্থিসন্ধি ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গেও বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে—
• এপিস্ক্লেরাইটিস, স্ক্লেরাইটিস -এর মতো জটিল অসুখ দেখা যেতে পারে চোখে।
• রক্তবাহী ধমনীগুলিতে প্রদাহ দেখা যেতে পারে ও হতে পারে ভাসকুলাইটিস।
• আক্রান্ত হতে পারে স্নায়ু।
• আক্রান্ত হতে পারে ফুসফুসও। দেখা দিতে পারে ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিজিজ। রোগীর দীর্ঘদিন ধরে কাশি হয়। এছাড়া প্লুরাল ইফিউশন অর্থাৎ ফুসফুসকে ঘিরে যে আচ্ছাদন বা প্লুরা থাকে সেই আচ্ছাদনে জমতে পারে জল।
• হার্টের অসুখ হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
• দেখা দিতে পারে পক্ষাঘাত।
মোটকথা রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস গোটা শরীরের সিস্টেমকেই প্রভাবিত করতে পারে।
রোগ নির্ণয় পদ্ধতি
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ইএসআর, সি-রিয়্যাকটিভ প্রোটিনের মাত্রা দেখা দরকার। দরকারে রিউম্যাটয়েড ফ্যাক্টর এবং অ্যান্টি-সিসিপি টেস্ট করানো হয়। এছাড়া হাই রেজোলিউশন আলট্রাসাউন্ড-এর মতো ইমেজিং টেস্ট করেও জয়েন্টের কতখানি সমস্যা হয়েছে তা বোঝা যায়।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগের চিকিৎসা
আধুনিক সময়ে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের একাধিক ভালো ওষুধ রয়েছে। যেমন- মেথোট্রেক্সেট, সালফাসালাজিন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। এছাড়া প্রথম কয়েকমাস রোগীকে একটু স্বস্তিতে রাখতে তাকে ব্যথার ওষুধ বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। এছাড়া আছে বায়োলজিক রেসপন্স মডিফায়ারস-এর মতো ওষুধও। তবে জয়েন্ট খুব বেঁকে গেলে ও বৈকল্য দেখা দিলে সেক্ষেত্রে অপারেশন করানোর দরকার পড়তে পারে।
মনে রাখবেন—
• নি- অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অস্থিসন্ধিতে থাকা কার্টিলেজের ক্ষয়ের কারণে। এই কারণে পঞ্চাশোর্ধ্বদের মধ্যে নি অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা হাঁটুর বাতের প্রদাহ দেখা যায়। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস কিন্তু ক্ষয়ের কারণে হয় না। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসও প্রদাহজনিত আর্থ্রাইটিস। প্রদাহজনিত আর্থ্রাইটিস দেখা যায় কম বয়সে। এই কারণে ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সি ব্যক্তির মধ্যে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের প্রকোপ দেখা যায়।
• পুরুষদের তুলনায় মহিলারা এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন।
• ওষুধ খেতে শুরু করার পর শরীর ভালো থাকলে ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের মতো এই অসুখেও একটানা ওষুধ খেয়ে যেতে হয়।
• রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস থাকলে সন্তানধারণে কোনও সমস্যা হয় না। কারণ এমন কিছু ওষুধ রয়েছে যা সন্তানসম্ভবা অবস্থাতেও রোগী খেতে পারেন। তবে সন্তানধারণ করার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত।