অনেক শিশুই অ্যালার্জিতে ভোগে। সব সময়ে বাবা মা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না। ফলে বাচ্চা বড় হওয়ার পর সমস্যা গুরুতর রূপ নেয়। ছোট্ট বয়স থেকে শিশুর অ্যালার্জির চিকিৎসা করালে বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা-মায়েরও ভোগান্তি কমবে।
অ্যালার্জি কাকে বলে ?
মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার অতিরিক্ত সংবেদনশীলতার জেরে সৃষ্টি হওয়া কতকগুলি প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে অ্যালার্জি বলে। এগুলি একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতেই পারে। নাক দিয়ে জল পড়া, চুলকুনি, চামড়ায় লাল বা কালো ছোপ সমেত অনেক অসুবিধাই অ্যালার্জির অন্তর্ভুক্ত।
শিশুদের অ্যালার্জির ধরণ
শিশুর নাকে অ্যালার্জি :- অ্যালার্জিক রাইনাইটিস শিশুদের একটি দীর্ঘমেয়াদি অ্যালার্জিজনিত রোগ। নাকের অভ্যন্তরে ঝিল্লি বা মিউকাস পর্দায় প্রদাহের জেরে এই সমস্যা হয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায় বা জন্মের প্রথম বছরে মা যদি ধূমপান করেন, তাহলে সন্তানের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সিজারিয়ান ডেলিভারি, অ্যালার্জিক পরিবেশ, জীবাণু ও খাবার এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। পরিবারে মা, বাবা বা অন্য কারও এ ধরনের অ্যালার্জির ইতিহাস থাকলে, শিশুর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। নাক বন্ধ, নাক দিয়ে জল পড়া, খালি খালি নাক চুলকানো, সঙ্গে চোখ লাল এবং হঠাৎ হঠাৎ বাড়াবাড়ি রকম হাঁচি—এসবই অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের প্রধান উপসর্গ। একটু বেশি বয়সী শিশু নাকের এই অ্যালার্জিতে নাক ঘষে (অ্যালার্জিক স্যালিউট)। কোনো কোনো শিশুর নাকের ওপর আড়াআড়ি দাগ, কারও আবার চোখের নিচে গোলগোল কালো ছোপ পড়ে যায়। অস্বস্তি হওয়ায় চার–পাঁচ বছর বয়সী অনেক শিশু নাক ডাকে, মুখ হাঁ করে শ্বাস নেয়। ফলে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এদের অনেকেই মন দিয়ে লেখাপড়া করতে পারে না। অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে ভোগা শিশুদের অনেকে অ্যালার্জিজনিত অন্যান্য অসুখ, যেমন সাইনোসাইটিস, কানপাকা, টনসিলের সংক্রমণ ও একজিমা রোগে ভোগে। এসব শিশুর অনেকে অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়। দীর্ঘমেয়াদি অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে ভোগা শিশুদের সপ্তাহে চার দিনের বেশি কিংবা পরপর চার সপ্তাহ রোগের উপসর্গ থাকতে পারে। তবে মৃদু অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিক ঘুমে ও লেখাপড়ায় বড় মাপের সমস্যা হয় না।
রোগ শনাক্ত করতে নির্দিষ্ট কিছু টেস্ট করার প্রয়োজন হয়। টেস্টগুলির মধ্যে ছয় বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে উচ্চ মাত্রার ইমিউনোগ্লোবিউলিন ই, ইঁদুর, আরশোলা ও অন্যান্য সন্দেহজনক অ্যালার্জেন পরীক্ষা অন্যতম। শিশুর এই রোগ কোন ঋতুতে বাড়ে অভিভাবককে সেটাও লক্ষ্য করতে হবে। যে যে পরিবেশ বা খাবার এমন অ্যালার্জির জন্য দায়ী তাও চিহ্নিত করা জরুরী। কুকুর, বিড়াল সহ সব পোষা প্রাণীর সংস্পর্শ, বিছানা, বালিশ, কার্পেটে থাকা ধুলোর মধ্যেকার জীবাণু, ফুলের পরাগ, ঘাস, কড়া গন্ধ এবং ধুলোবালির সংস্পর্শে এলে সমস্যা বাড়ছে কি না, তাও লক্ষ্য করতে হবে। অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে আক্রান্ত শিশুকে সারানোর জন্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ই-এন-টি (নাক-কান-গলা) ও অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞের পরামর্শে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
শিশুর ত্বকে অ্যালার্জি :- একদম ছোট বয়স থেকে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত যে কোনও সময়ে শিশুর ত্বকে অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকেরই অসুখের প্রথম পর্যায়ে আসল সমস্যা ধরা পড়ে না। তবে কয়েকটি উপসর্গ থেকে বোঝা যায় যে শিশু অ্যালার্জির সমস্যায় আক্রান্ত। সেগুলি কিরকম একটু দেখে নেওয়া যাক। শিশুর ত্বকে যদি ফুসকুড়ি, চুলকানির সমস্যা অব্যাহত থাকে তা হলে গুরুত্ব নিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ছাড়াও হাঁচি, শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জি তো আছেই। বাড়িতে কারও যদি অ্যালার্জি থাকে তা হলে এই ধরনের উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে চাইল্ড স্পেশালিষ্টের কাছে নিয়ে যান। শিশুর ত্বকে যে সব অ্যালার্জি হতে পারে :
১) একজিমা – হাত, গাল, মাথার ত্বকে একজিমা দেখা দিতে পারে । এটি মূলত ত্বকের প্রদাহজনিত । এক থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের মধ্যে একজিমা দেখা দিতে পারে। একজিমা হলে এদের চামড়ায় র্যাশ, ফুসকুড়ি ও লালচে ফোঁড়ার মতো হতে পারে।
২) আরটিকেরিয়া – এই ধরনের র্যাশ গলার কাছে, হাতে ও মুখে দেখা দিতে পারে। সাধারণত দুই থেকে তিন বছর বয়সী বাচ্চাদের এমন অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে।
৩) মিলিয়ারিয়া – গরমের জেরে শিশুদের ত্বকে যে র্যাশ দেখা দেয় তার নাম মিলিয়ারিয়া। শিশুর মুখে, ঘাড়ে ও গলায় এই ধরনের অ্যালার্জি বেশি হয়ে থাকে।
বাচ্চাদের ত্বকে অ্যালার্জির সমস্যা হওয়ার কারণ
শিশুদের বিভিন্ন খাবার থেকে অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। দুধ, ডিম, বাদাম, চিংড়ি মাছ ও কাঁকড়ার মতো খাবার থেকে প্রায়শই শিশুদের অ্যালার্জি হয়ে থাকে। তবে রাসায়নিক পদার্থ এবং ধুলো-বালিও অ্যালার্জির কারণ হতে পারে।
শিশুদের খাদ্যজনিত অ্যালার্জি – শিশু বয়সের খাবারে অ্যালার্জি নির্ণয়ে রোগের ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা ও নির্দিষ্ট খাবার চিহ্নিত করা জরুরি। এ জন্য রক্তের কিছু টেস্ট ও আধুনিক পদ্ধতিতে অ্যালার্জি পরীক্ষা করা হয়। অনেক শিশুর কোনও নির্দিষ্ট খাবার গ্রহণের পর অ্যালার্জিজনিত নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এটি মূলত দুই ধরনের। এক- খাদ্য বা খাদ্য প্রসেসিং (প্রক্রিয়াজাতকরণ) করার সময় ব্যবহৃত কোনো উপকরণ বা রাসায়নিক পদার্থ থেকে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া। উদাহরণ স্বরূপ- দুগ্ধজাত খাদ্য সহ্য না হওয়া। দুই- অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া। এটি ইমিউনোলোজিক প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়। এমন অ্যালার্জিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের রক্তে অত্যধিক পরিমাণ allergen-specific immunoglobulin E অথবা আইজি-ই পাওয়া যায়। গরুর দুধ, ডিম, বাদাম বা মটরদানার মতো খাবার থেকে এমন অ্যালার্জি হয়। খাবার থেকে শিশুদের এ ধরনের অ্যালার্জির সঙ্গে অনেক সময় জিনগত কারণও থাকে।
অ্যালার্জির লক্ষণ
ত্বকে লাল লাল ছোপ, চুলকানো, নিচের আস্তরণ সহ চামড়ায় ফোলা ভাব।
চোখ খচখচ করা, চোখ লাল, জল ঝরা।
নাক বন্ধ, হাঁচি, গলা চুলকানো, নাক দিয়ে জল পড়া, গলার স্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া, শুকনো কাশি।
শ্বাসকষ্ট, শ্বাসে শাঁইশাঁই শব্দ ইত্যাদি।
ঠোঁট, জিভ ফুলে যাওয়া, ঠোঁটের চারপাশে লাল দাগ ও চুলকানি।
বমি ভাব, বমি, পেট কামড়ানো, ডায়রিয়া।
হার্টে দ্রুত বা কম স্পন্দন, রক্তচাপ কমে যাওয়া, মূর্চ্ছা যাওয়া।
কোন কোন খাবারে অ্যালার্জি থাকে ?
কারও কারও মুরগির ডিমে অ্যালার্জি থাকে। এমনটা হয়ে থাকলে তার অন্য ডিমে অ্যালার্জি থাকার আশঙ্কাও প্রবল। শিশুর ডিমে অ্যালার্জি সাধারণভাবে শূন্য থেকে এক বছর বয়সে শুরু হয় এবং পঁচাত্তর শতাংশ বাচ্চার ক্ষেত্রে সাত বছর বয়সে ঠিক হয়ে যায়।
গরুর দুধে অ্যালার্জি সাধারণত শূন্য থেকে এক বছর বয়সে শুরু হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই রকম অ্যালার্জি পাঁচ বছর বয়সে লোপ পায়।
অনেক বাচ্চারই মটর বা বীজ–জাতীয় খাবারে অ্যালার্জি থাকে। এ ধরনের অ্যালার্জি শিশুর এক থেকে দুই বছরে শুরু হয়। প্রায় কুড়ি শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে পরে এই সমস্যা ঠিক হয়ে যায়। বাকিদের সমস্যা সারা জীবন থেকে যায়।
কোনো কোনো খাবার, যেমন সামুদ্রিক মাছ, গম, সয়াবিন, আপেল, গাজর—এসব থেকে একেক বয়সে অ্যালার্জি হতে পারে। আবার অনেক বাচ্চার একটি নির্দিষ্ট বয়সে এই সমস্যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেরেও যেতে পারে। এ ছাড়া গরুর দুধ ও ডিমে অ্যালার্জি প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বাচ্চার ছয় থেকে সাত বছর বয়সে সেরে যায়। তবে কখনো কখনো দেখা যায়, মটর বা বীজে অ্যালার্জি প্রায় সারা জীবনের জন্য থেকে যায়।
শিশু বয়সের খাবারে অ্যালার্জি নির্ণয়ে রোগের ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা ও নির্দিষ্ট খাবার চিহ্নিত করা দরকার। এ জন্য রক্তের কিছু টেস্ট ও বিশেষ পদ্ধতিতে অ্যালার্জি টেস্ট করা হয়। কোন কোন খাবারে শিশুর অ্যালার্জি তা চিহ্নিত করতে হবে। শিশুর খাবারের তালিকা থেকে ওই সব খাবার সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে। তবে শিশু বিশেষজ্ঞ ও অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলার পরে কড়া তত্বাবধানে অল্প অল্প করে এসব খাবার একটি নির্দিষ্ট বয়স থেকে বাচ্চাকে ফের দেওয়া যেতে পারে।
অ্যালার্জি নির্ণয়
ত্বকের বিভিন্ন টেস্ট ও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে অ্যালার্জি নির্ণয় করা হয়। অ্যালার্জি ধরা পড়লে বাচ্চার দৈনিক জীবনযাপন এবং খাওয়াদাওয়াতেও বড় মাপের পরিবর্তন আসে। প্রথম প্রথম বাচ্চা এই সব পরিবর্তন মেনে না নিয়ে জেদ করতে পারে। সেই সময় বাবা-মাকে ধৈর্য রাখতে হবে।ঠিক মতো নিয়ম মেনে না চললে সমস্যা মারাত্মক আকার নিতে পারে।