ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড বা জরায়ুর টিউমার হল জরায়ুর ভেতর তৈরি হওয়া একপ্রকার টিউমারের ।যে হেতু এটি একটি টিউমার তাই সবার মনেই প্রশ্ন আসে- ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড কি ক্ষতিকর কোনও টিউমার? জরায়ুর টিউমার বা ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড কি ক্যান্সারাস? এর উত্তর হল – ‘না’ । যেহেতু এটা ক্যান্সারাস নয়, তাই রোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে তিনি সার্জারী করবেন না করবেন না। ফাইব্রয়েড যদি শরীরে কোনো সমস্যা তৈরি না করে, তাহলে সার্জারীর প্রয়োজন হয় না। যে যে ক্ষেত্রে সার্জারী করা যেতে পারে, সেগুলো হল—
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত
- দুটো মাসিকের মাঝে রক্তপাত হওয়া
- তলপেটে চাপ ধরা এবং ব্যথা
- বারবার মূত্রত্যাগের প্রয়োজন
- মুত্রথলি খালি হতে সমস্যা হওয়া
সার্জারী তখনও প্রয়োজন হয় যখন রোগী ভবিষ্যতে সন্তান ধারন করতে চায়, কারন ফাইব্রয়েডের উপ্সথিতি অনেক সময় সন্তান ধারনে বাধা প্রদান করে, নানা কম্পলিকেশন তৈরি করে এবং মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আপনি যদি সার্জারী করতে চান তাহলে আপনার কাছে দুই রকমের বিকল্প আছে—
- মায়োমেকটমি
- হিসটেরেকটমি
সার্জারী ফাইব্রয়েডের সমস্ত রোগলক্ষন কে সারিয়ে তোলে, কিন্তু এর অনেক বিপদও আছে। আপনার চিকিৎসক সার্জারীর অপশনগুলো নিয়ে আপনার সাথে কথা বলবেন এবং তখন আপনারা সিদ্ধান্ত নেবেন যে সার্জারীর প্রয়োজন আছে কিনা এবং তা কোন প্রকারের।
ফাইব্রয়েড সার্জারীর ধরন
ফাইব্রয়েড সার্জারীর দুধরনের পদ্ধতি আছে। কোনটা আপনার জন্য প্রয়োজন হবে তা নির্ভর করে —
- ফাইব্রয়েডের আকারের ওপর
- ফাইব্রয়েডের সংখ্যার ওপর
- ইউটেরাসের কোথায় ফাইব্রয়েডের অবস্থান
- আপনি ভবিষ্যতে সন্তান ধারন করতে চান কি না
মায়োমেকটমি
মায়োমেকটমি, ফাইব্রয়েড এবং তার অন্যান্য রোগ লক্ষন যেমন অতিরিক্ত রক্তপাত ইত্যাদিকে বন্ধ করে দেয়। এই সার্জারী তখন করা হয়, যখন রোগী ভবিষ্যতে সন্তান ধারন করতে চান বা অন্য কোনো কারনে তাঁর জরায়ুর প্রয়োজন হতে পারে এমন ক্ষেত্রে।
৮০% থেকে ৯০% মহিলাই মায়োমেকটমির মাধ্যমে রোগলক্ষন থেকে মুক্তি পায় বা তাদের রোগলক্ষন কমে যায়। বাদ দেওয়া ফাইব্রয়েডগুলো সার্জারীর পরে আর ফিরে আসে না, তবে আবার নতুন ফাইব্রয়েড তৈরি হতে পারে। এই সার্জারি করা ৩৩% মহিলার পাঁচ বছরের ভেতর আবার সার্জারী করার প্রয়োজন হয়েছে, কারন ইউটেরাসে তাদের নতুন ফাইব্রয়েডের জন্ম হয়েছে।
এই সার্জারি তিনটি পদ্ধতির ভেতর যেকোনো একটি ভাবে করা হয়, এবং কোন পদ্ধতিতে হবে, তা নির্ভর করে ফাইব্রয়েডের সংখ্যা, আকার ও অবস্থানের ওপর। এই ক্ষেত্রে জেনারেল অ্যানাস্থেসিয়া করা হয়।
হিস্টেরেস্কোপি
যেসব মহিলাদের ফাইব্রয়েড ছোট এবং খুব অল্প পরিমানে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে এই সার্জারি খুব উপযোগী। এই সার্জারীর মাধ্যমে জরায়ুর ভেতর দিকে থাকা ফাইব্রয়েডকেও বাদ দেওয়া যায়।
এই পদ্ধতিতে চিকিৎসক রোগীর যোনিপথের মাধ্যম দিয়ে লম্বা, সরু এবং আলো আছে এরকম একটা টেলিস্কোপ প্রবেশ করাবেন এবং রোগীর জরায়ুতে ফ্লুইড ইঞ্জেক্ট করা হয় যাতে চিকিৎসক ফাইব্রয়েডগুলো ভালো ভাবে দেখতে পারেন। এরপর চিকিৎসক কোনো ডিভাইসের মাধ্যমে ওই ফাইব্রয়েডগুলো বাদ দিয়ে দেবেন এবং জরায়ুতে ইঞ্জেক্ট করা ফ্লুইডের মাধ্যমে ফাইব্রয়েডগুলো শরীরের বাইরে চলে আসে।
এই সার্জারীতে রোগী সার্জারীর দিনই বাড়ি চলে যেতে পারেন।
অ্যাবডোমিনাল মায়োমেকটমি
এই পদ্ধতিটিকে ল্যাপারোটমিও বলা হয় এবং এটি বড় আকারের ফাইব্রয়েডের জন্য প্রযোজ্য। তবে এই সার্জারীতে অনেক বড় দাগ তৈরি হয়। চিকিৎসক রোগীর তলপেট কেটে ফাইব্রয়েড বের করেন। এই সার্জারীর পর এক থেকে তিন দিন পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হয় এবং সম্পূর্ণ সুস্থতার জন্য দুই থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে।
ল্যাপ্রোস্কোপি
যেসব মহিলাদের ছোট এবং কম পরিমানে ফাইব্রয়েড থাকে তাদের ক্ষেত্রে ল্যাপ্রোস্কোপি ব্যবহার করা হয়। ল্যাপ্রোস্কোপির সময় চিকিৎসক পেটের ওপর দুটো ছোট ছোট জায়গা কাটেন। কোনো একটা কাটার ভেতর দিয়ে চিকিৎসক একটা টেলিস্কোপ প্রবেশ করান যাতে তিনি রোগীর পেলভিস এবং জরায়ু কে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। অন্য কাটা অংশটার মাধ্যমে কিছু ডিভাইসের মাধ্যমে চিকিৎসক সেই ফাইব্রয়েডগুলো কেটে বার করেন।
চিকিৎসক ফাইব্রয়েডগুলো কে অনেক ছোট টুকরো তে ভেঙে নেন। রোবোটিক ল্যাপ্রোস্কোপিতে চিকিৎসক রোবোটিক হ্যাণ্ডস ব্যবহার করেন এই সার্জারীর জন্য।
ল্যাপ্রোস্কোপি সার্জারীতে একদিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে, তবে অ্যাবডোমিনাল মায়োমেকটমির থেকে অনেক দ্রুত সুস্থতা হয়।
হিসটেরেক্টমি
হিসটেরেক্টমিতে জরায়ুর কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ জরায়ু টাই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। রোগীর টিউমার যদি সংখ্যায় অনেক, আকারে বড় ফাইব্রয়েড থাকে এবং রোগীর যদি ভবিষ্যতে সন্তান ধারনের কোনো পরিকল্পনা না থাকে তাহলে এই সার্জারী করা হয়। সার্জেন কয়েকটি পদ্ধতিতে জরায়ু কে বাদ দিতে পারেনঃ
ল্যাপারোটমি অথবা অ্যাবডোমিনাল হিসটেরেক্টমি
সার্জেন সার্জারীর মাধ্যমে তলপেটে কেটে জরায়ু বাদ দিয়ে দেন।
ভ্যাজাইনাল হিসটেরেক্টমি
সার্জেন রোগীর যোনিপথের মাধ্যমে জরায়ু বাদ দেন, তবে অনেক বড় ফাইব্রয়েড এর ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে কাজ হয় না।
ল্যাপরোস্কোপিক হিসটেরেক্টমি
এই পদ্ধতিতে সার্জেন কিছু ইনস্ট্রুমেন্টস প্রবেশ করিয়ে জরায়ুকে ছোট ছোট টুকরো তে কেটে বের করে আনেন।
সার্জেন রোগীর ডিম্বাশয় এবং সার্ভিক্সকে অক্ষত রাখেন, ফলে রোগী আবার ফিমেল হরমোন তৈরি করতে পারেন। অ্যাবডোমিনাল হিসটেরেক্টমিতে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। ল্যাপরোস্কোপি হিসটেরেক্টমি এবং ভ্যাজাইনাল হিসটেরেক্টমিতে সুস্থতা অনেক দ্রুত আসে।
এন্ডোমেট্রিয়াল অ্যাবলেশান
এটি ঠিক সার্জারী নয়, এবং এতে ইউটেরাসের লাইনিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেসব মহিলাদের খুব ছোট আকৃতির ফাইব্রয়েড ইউটেরাসের একদম ভেতর দিকে থাকে তাদের ক্ষেত্রে এটা সবথেকে ভালো কাজ করে। অ্যাবলেশান ফাইব্রয়েড কে বাদ দেয় না, এর ফলে অতিরিক্ত রক্তপাত বন্ধ হয়। যেসব মহিলারা ভবিষ্যতে সন্তান ধারন করতে চান তাদের জন্য এই পদ্ধতি একেবারেই উপযুক্ত নয়।
এইসময় চিকিৎসক রোগীকে সম্পূর্ণ বা আংশিক অ্যানাস্থেশিয়া করা হয়। চিকিৎসক একটা বিশেষ ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে ইউটেরাইন লাইন একপ্রকার পুড়িয়ে দিয়ে কাজটা করেন। এর জন্য তিনি যে পদ্ধতিগুলি ব্যবহার কিরেন, তা হল —
- ইলেক্ট্রিক কারেণ্ট
- উত্তপ্ত ফ্লুইড ভর্তি একটি বেলুনের মতো পদার্থের সাহায্যে
- হাই এনার্জি রেডিও ওয়েভ
- মাইক্রোওয়েভ এনার্জি
- উত্তপ্ত ফ্লুইড
এই পদ্ধতি যেদিন হচ্ছে রোগী সেদিনই বাড়ি চলে যেতে পারেন, তবে সম্পূর্ণ সুস্থতা নির্ভর করছে কোন প্রকারের অ্যাবলেশান করা হয়েছে তার ওপর। ফাইব্রয়েড এর ফলে হওয়া অতিরিক্ত রক্তপাত থেকে অ্যাবলেশান পদ্ধতিতে মুক্তি পাওয়া যায়।
উপকারিতা
ফাইব্রয়েড সার্জারী এবং অ্যাবলেশান এর মাধ্যমে ফাইব্রয়েড সংক্রান্ত রোগ লক্ষন যেমন অতিরিক্ত রক্তপাত এবং পেটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ইউটেরাস বাদ দেওয়া ফাইব্রয়েড এর থেকে মুক্তি পাওয়ার স্থায়ী উপায়।
ঝুঁকি
এইসব পদ্ধতিগুলিই নিরাপদ, কিন্তু কিছু কিছু ঝুঁকি থেকে যায়। যেমন
- রক্তপাত
- সংক্রমণ
- আবার সার্জারীর প্রয়োজন
- পেটের কাছাকাছি অবস্থিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হওয়া
- মলমূত্র ত্যাগে সমস্যা
- জনন সংক্রান্ত সমস্যা
- প্রেগন্যান্সিতে সমস্যা
সার্জারী এবং ফার্টিলিটি (জনন ক্ষমতা)
হিসটেরেক্টমি হলে আর সন্তান ধারন করা যায় না, কারণ এতে জরায়ু বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। মায়োমেক্টমি হলে সন্তান ধারন সম্ভব।
অ্যাবলেশান হলে সাধারণত সন্তান ধারন সম্ভব নয়, তবে রোগীকে নিয়মিত জন্মনিরোধক গ্রহন কিরতে হবে, কারণ এই পদ্ধতিতে এন্ডোমেট্রিয়াল লাইনিং, অর্থাৎ যেখানে ডিম্বাণুটির ইমপ্লান্ট হয় সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই রোগী গর্ভবতী হলে গর্ভপাত ও অন্যান্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
রোগী যদি এমন কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন যে যাতে তিনি প্রেগন্যান্ট হতে পারবেন, তাহলে তাঁকে অন্তত তিনমাস বা তার বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে, যাতে জরায়ু সম্পূর্ণ ভাবে সেরে উঠতে পারে।
অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি
ওষুধের সাহায্যে
- নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টিইনফ্লামেটরি ড্রাগ যেমন আইবুপ্রুফেন এবং ন্যাপ্রক্সেন ব্যথা কমাতে সাহায্য করে
- বার্থ কন্ট্রোল পিল এবং অন্যান্য বার্থ কন্ট্রোল পদ্ধতি অতিরিক্ত রক্তপাত বন্ধ করতে সাহায্য করে
- অ্যান্টি হরমোনাল ড্রাগ যেমন প্রোজেস্টিন বা ডানাজোল ইস্ট্রোজেন কে ব্লক করে ফাইব্রয়েডের চিকিৎসায় সাহায্য করে।
- গোনাডোট্রোপিন রিলিজং হরমোন অ্যাগোনিস্ট ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের উৎপাদন বন্ধ করে সাময়িক মেনোপজ তৈরি করে, ফলে ফাইব্রয়েডগুলো আকারে ছোট হয়ে যায়। চিকিৎসক এটা সার্জারীর আগে প্রেসক্রাইব করতে পারেন ফাইব্রয়েডের আকার ছোট করে সার্জারীতে সুবিধা করার জন্য।
নন – ইনভেসিভ পদ্ধতি
- MRI গাইডেড ফোকাসড আল্ট্রা সাউণ্ড পদ্ধতিতে MRI স্ক্যানারের তাপের মাধ্যমে ত্বকের ওপর থেকেই ফাইব্রয়েডকে ধ্বংস করা হয়।
- ইউটেরাইন আর্টারি এমবোলাইজেশনে ছোট ছোট কিছু টুকরো পদার্থ ধমনীর ভেতর ইঞ্জেক্ট করা হয়, ফলে ইউটেরাসে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয় এবং ফাইব্রয়েডগুলো আকারে ছোট হয়ে যায়।
- মায়োলাইসিসে উত্তাপ দিয়ে ইউটেরাসের রক্ত জালিকাকে ও ফাইব্রয়েড কে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়।
- ক্রায়োমায়োলাইসিসে একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, কেবল ফাইব্রয়েডগুলি কে জমিয়ে দেওয়া হয়।
চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করুন, উনিই সঠিক ভাবে বলতে পারবেন, কোন পদ্ধতি আপনার জন্য উপযুক্ত। সমস্ত পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবে জেনে নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।