ভাইরাস অথবা ব্যকটিরিয়ার সংক্রমণের ফলে আমাদের শ্বাসনালীর আবরণের ঝিল্লিতে যখন প্রদাহ হয় এবং ফুলে যায়, তখন তাকে ব্রঙ্কাইটিস বলা হয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর অনবরত কাশি ও ঘন শ্লেষ্মা উঠতে দেখা যায়। ব্রঙ্কাইটিস দুই রকমের হতে পারে।
১) অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিস (Acute Bronchitis) : ঠান্ডা লেগে বা অন্য কোনো শ্বাসযন্ত্র জনিত সংক্রমণ (infection) এর কারণে অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিস হয়ে থাকে। এটি খুবই সাধারণ রোগ ও এই রোগে প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হন। রোগলক্ষন কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হয়। সাধারণত বড়সড় কোনো সমস্যা এর দ্বারা তৈরি হয় না।
২)ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস (Chronic Bronchitis): এই অবস্থাটি খুবই গুরুতর। এতে শ্বাসনালীর ঝিল্লির প্রদাহ বারেবারে ফিরে আসে এবং সাধারণত এটি সারে না। ধূমপান কেই এর প্রধান কারণ হিসাবে ধরা হয়। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস কে “ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) এর আওতায় ফেলা হয়।
ব্রঙ্কাইটিসের লক্ষনগুলি কি কি ? ( Symptoms of Bronchitis )
বুকে চাপ ধরা অনুভূতি
কাশির সাথে শ্লেষ্মা যা স্বচ্ছ, সাদা, সবুজ ও ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে এবং কখনো কখনো কাশির সাথে রক্তও পড়ে।
ক্লান্তি
শ্বাসকষ্ট
হাল্কা জ্বর ও তার সাথে কাঁপুনি
কাশির সময়ে বুকে ব্যাথা হওয়া
শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় শীস দেওয়ার মতো শব্দ হওয়া
অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিসের রোগলক্ষন চলে যাওয়ার পরও বেশ কিছু সপ্তাহ ধরে কাশি থেকে যায় যতক্ষন না পর্যন্ত শ্বাসনালীর ফোলা ভাব সম্পূর্ণ কমে যায়। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের ক্ষেত্রে রোগলক্ষন ৩ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং সাধারণত দু’বছর পর পর ফিরে আসে।
ডাক্তারের কাছে অবশ্যই যাওয়া প্রয়োজন যদি কাশি
তিন সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়
ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়
সাথে 100.4 F এর বেশি জ্বর থাকে
সাথে রক্ত আসে
সাথে শ্বাসকষ্ট ও শীসের মতো শব্দ হয়
ব্রংকাইটিস কেন হয় বা কারণ কি?
সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস যা জ্বর–সর্দিকাশি এর জন্য দায়ী, সেই ভাইরাসের কারণেই অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিস হয়ে থাকে, তবে কখনো কখনো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণেও এই প্রকার ব্রঙ্কাইটিস হয়ে থাকে। তবে দুই ক্ষেত্রেই আমাদের শরীর সেই জীবাণুর সাথে লড়াই করে এবং শ্বাসনালী ফুলে যায় ও অতিরিক্ত পরিমানে কফ উৎপাদন করে। এর ফলে শ্বাসনালীর ভিতরের পথটি সরু হয়ে যায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বাতাস যেতে পারে না আর ফলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
দূষিত বায়ুতে শ্বাসগ্রহণ, ধূলো, রাসায়নিক ধোঁয়া, দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান ও পরোক্ষ ধূমপান (passive smoking) ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের কারণ
কাদের এই রোগের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ?
যারা ধূমপান করেন।
Asthma ও অ্যালার্জি থাকলে
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি দুর্বল হয়ে থাকে (শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এবং অন্য কোনো রোগে দীর্ঘদিন ভুগলে হয়ে থাকে)
পরিবারে যদি কারোর ফুসফুসের রোগ থাকে
পুরুষ ধূমপায়ীদের থেকে মহিলা ধূমপায়ীরা অনেক বেশি বিপদের মুখে থাকেন
ব্রঙ্কাইটিস রোগ নির্নয় কিভাবে হয়?
বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা ও রোগলক্ষন দেখে ডাক্তারবাবু রোগ নির্ণয় করে থাকেন। তিনি কাশির ধরন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন, যেমন কতদিন ধরে কাশি হচ্ছে, বা কাশির সাথে যে কফ উঠছে তার রঙ কেমন ইত্যাদি। ফুসফুসের নানা পরীক্ষা করবেন তাঁরা এবং শ্বাস–প্রশ্বাসের সময় কোনো রকম শীস দেওয়ার মতো শব্দ হচ্ছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখবেন। অ্যাকিউট ন ক্রনিক কোন ধরনের ব্রংকাইটিস হয়েছে তা বোঝার জন্য আরও নানারকম পরীক্ষা করা হয়। যেমনঃ–
রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণয় :
একটি সেন্সর (Oximeter) আঙুলের মাথায় লাগিয়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণয় করা হয়
ফুসফুসের কর্মক্ষমতার পরীক্ষা (Lung function test) :
স্পিরোমিটার (spirometer) নামক এক যন্ত্রের জোরে ফুঁ দেওয়ার মতো করে শ্বাস ছাড়তে হয় এই পরীক্ষায়। Emphysema ও Asthma রোগ নির্ণয় করা হয় এই পরীক্ষার মাধ্যমে।
চেষ্ট এক্স–রে :
নিউমোনিয়া ও অন্য কোনো রোগের কারণে কাশি হচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য করা হয়।
রক্ত পরীক্ষা :
কোনো সংক্রমণ হয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য এবং রক্তে অক্সিজেন ও কার্বনডাই-অক্সাইড এর মাত্রা বোঝার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়।
কফ পরীক্ষা : যদি ডাক্তার মনে করেন রোগী “হুপিং কাশি” তে আক্রান্ত তাহলে এই পরীক্ষা করতে পারেন। এই রোগে ভয়ঙ্কর ভাবে কাশি হয়, যার ফলে রোগীর শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয়।
ব্রঙ্কাইটিসের চিকিৎসা
যদি ব্রঙ্কাইটিস ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয় (যা বিরল) তাহলে ডাক্তারবাবু অ্যাএন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করেন। যদি asthma বা allergy থাকে, অথবা শ্বাস–প্রশ্বাসের সময় শীস দেওয়ার মতো শব্দ হয় তাহলে ইনহেলার দেওয়া হয়, যা শ্বাসনালীর পথকে প্রশস্ত ও মুক্ত করে শ্বাস গ্রহণে সুবিধা ঘটায়।
অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিসের ক্ষেত্রে আরাম পেতে রোগী যা যা করতে পারেন —
প্রচুর জলপান করা। দিনে প্রায় ৮–১২ গ্লাস। এর ফলে কফ পাতলা হয়ে যায় এবং তা সহজে উঠে যায়।
পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম গ্রহন
যন্ত্রণানাশক ওষুধ খাওয়া। Aspirin, Ibuprofen, Naproxen যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করে। তবে বাচ্চাদের Aspirin দেওয়া উচিৎ নয়। সেক্ষেত্রে Acetaminophen ব্যবহার করা যায়, যা একই সাথে যন্ত্রণা ও জ্বর কমাতে সাহায্য করে।
গরম জলে স্নান করা, স্টিমবাথ নেওয়া ইত্যাদিতেও কফ তরল হয়ে যায়।
Guaifenesin জাতীয় কফসিরাপ ব্যবহার করলে সহজেই কফ উঠে যায়। তবে শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া বাচ্চাদের কোনো ওষুধ দেওয়া উচিৎ নয়।
ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের চিকিৎসা রোগলক্ষন ধরে করা হয়—
Antibiotics, anti-inflammatory জাতীয় ওষুধ এবং শ্বাসনালীর পথকে উন্মুক্ত করার জন্য Bronchodilators জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়।
কফকে সহজ ভাবে বের করার জন্য যন্ত্র ব্যবহার করা হয়
রোগী যাতে ভালো ভাবে শ্বাস নিতে পারে তাই অক্সিজেন থেরাপি করা হয়।
পালমোনারি রিহ্যাব নামক এক ধরনের এক্সারসাইজ প্রোগ্রাম করানো হয়, যাতে রোগী সহজে শ্বাস নিতে পারে এবং আরো এক্সারসাইজ করতে পারে।
ব্রঙ্কাইটিসকে কি ভাবে রোধ করা যাবে ?
যে যে পদ্ধতি অনুসরণ করলে মানুষ অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিস থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সেগুলো হল—
ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে
ফ্লু ভ্যাক্সিন নিতে হবে, কারন ফ্লু ভাইরাস থেকেও ব্রঙ্কাইটিস হয়
Pertussis Vaccine ওপর নজর রাখতে হবে এবং সময় মতো নিতে হবে
ঘন ঘন হাত ধুতে হবে।
যে সমস্ত রাসায়নিকের ধোঁয়া বা দূষিত বাতাস ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে, সেইসব অঞ্চলে গেলে মুখে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।